এক বছর পার হলেও ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি বাংলাদেশ-ভারতের কোনো তদন্ত সংস্থা। কোনো দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই বহুল আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের স্পষ্ট কারণ বের করতে পারেনি। সম্প্রতি থানা পুলিশ, ডিবি পুলিশের হাত ঘুরে মামলার তদন্তভার পেয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) পুলিশ।
ভারতে উদ্ধার হওয়া খণ্ড-বিখণ্ড দেহাংশ শনাক্ত করার জন্য গত নভেম্বর মাসে কলকাতায় গিয়ে ডিএনএ নমুনা দেন আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। সেই পরীক্ষার প্রতিবেদন এখনো পায়নি বাংলাদেশের তদন্ত সংস্থা। কর্মকর্তারা বলছেন, ডিএনএ পরীক্ষার ওই প্রতিবেদনের ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করছে তদন্তের অগ্রগতি।
আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুল আজিম আনার ছিলেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য। গত বছর ১১ মে চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন। পরে জানা যায়, কলকাতায় ১৩ মে খুন হন তিনি।
গত এক বছরে থানা পুলিশ, ডিবি পুলিশের হাত ঘুরে মামলার তদন্তভার পেয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) পুলিশ। ১৫ মে মামলাটি ডিবি পুলিশ থেকে সিআইডিতে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন ঢাকার মহানগর হাকিম সাইফুজ্জামান। সেই নির্দেশে ডিবি থেকে সিআইডিতে যাচ্ছে আনার হত্যার তদন্তভার।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার রাজনৈতিকভাবে এ হত্যা থেকে ফায়দা নেওয়ার জন্য তাদের ফাঁসিয়েছে। এখনো এ মামলা বহাল আছে। ফ্যাসিস্ট আমলের মামলা, এখনো জামিন হচ্ছে না। তদন্তও শেষ হচ্ছে না।- আসামি শিমুল ভূঁইয়া ও তানভীর ভূঁইয়ার আইনজীবী আসাদুজ্জামান
ডিবি পুলিশ বলছে, আনারকে কলকাতায় হত্যার উদ্দেশ্যে গুম করার মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল ২৭ মে। তবে এই মুহূর্তে প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ মামলার তদন্ত ডিবি থেকে সিআইডিতে দেওয়ার জন্য নথিপত্র তৈরির কাজ চলছে।
কারাগারে আছেন ৭ জন, স্বীকারোক্তি দেননি সাইদুল করিম মিন্টু
এ মামলায় বাংলাদেশে সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন- ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু, জেলার ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু, সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, ফয়সাল আলী সাজী ওরফে তানভীর ভূঁইয়া, সিলিস্তি রহমান, মোস্তাফিজুর রহমান ও ফয়সাল আলী।
- আরও পড়ুন
- এমপি আনার হত্যা: ফেঁসে যাচ্ছেন একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা
- এমপি আনোয়ারুল খুনে ‘হানিট্র্যাপ’, কে এই নারী?
- মরদেহের টুকরো পাবলিক টয়লেটে নিয়ে হস্তান্তর করা হয়
- এমপির মরদেহ টুকরো করে রাখা হয় ফ্রিজে, ফেলা হয় ট্রলিব্যাগে করে
তাদের সবাই এখন কারাগারে। এই সাতজনের মধ্যে মিন্টু ছাড়া ছয়জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেই জবানবন্দির ভিত্তিতে পুলিশ বলছে, এমপি আনার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী তার বাল্যবন্ধু ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ঝিনাইদহের আক্তারুজ্জামান শাহীন। আর হত্যাকাণ্ডটি বাস্তবায়ন করেছেন চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল। তানভীর ও সিলিস্তিও হত্যাকাণ্ডস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
মামলা ছেড়ে দিয়েছেন সিলিস্তির আইনজীবী
এ মামলায় গ্রেফতার সিলিস্তা রহমানের আইনজীবী ইকবাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি কয়েকদিন আগে মামলাটা ছেড়ে দিয়েছি।’
আসামি শিমুল ভূঁইয়া ও তানভীর ভূঁইয়ার আইনজীবী আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সাবেক এমপি আনারকে হত্যা করা হয়েছে কলকাতায়। গুম ও হত্যার ঘটনা সেখানকার। অথচ মামলা হয়েছে বাংলাদেশে। মামলায় ভারতের কেউ জড়িত না। এটা তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার রাজনৈতিকভাবে এ হত্যা থেকে ফায়দা নেওয়ার জন্য তাদের ফাঁসিয়েছে। এখনো এ মামলা বহাল আছে। ফ্যাসিস্ট আমলের মামলা, এখনো জামিন হচ্ছে না। তদন্তও শেষ হচ্ছে না।’
মামলা সিআইডিতে দেওয়ার জন্য নথিপত্র প্রস্তুত চলছে। আজ/কালকের মধ্যে মামলাটি ডিবি থেকে সিআইডিতে হস্তান্তর করা হবে। মামলা এখনো তদন্তাধীন। ভারতে উদ্ধার আনারের খণ্ড-বিখণ্ড মরদেহের অংশ শনাক্ত করার জন্য তার মেয়ে ডরিন ডিএনএ নমুনা দেন। আমরা সেই ডিএনএ রিপোর্টের জন্য আবেদন করেছি।- মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক বাহালুল বাহার খান
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক বাহালুল বাহার খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘মামলা সিআইডিতে দেওয়ার জন্য নথিপত্র প্রস্তুত চলছে। আজ/কালকের মধ্যে মামলাটি ডিবি থেকে সিআইডিতে হস্তান্তর করা হবে।’
তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এখনো তদন্তাধীন। ভারতে উদ্ধার আনারের খণ্ড-বিখণ্ড মরদেহের অংশ শনাক্ত করার জন্য তার মেয়ে ডরিন ডিএনএ নমুনা দেন। আমরা সেই ডিএনএ রিপোর্টের জন্য আবেদন করেছি। এখন রিপোর্টের অপেক্ষায় আছি। মামলার তদন্ত এর ওপর অনেকটা নির্ভর করছে। ডিএনএ রিপোর্ট পেলে প্রতিবেদন জমা দেওয়া যাবে।’
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘মামলাটি ডিবি থেকে সিআইডিতে এসেছে। সিআইডির ঢাকা পশ্চিম বিভাগ মামলাটি তদন্ত করবে। এ মামলার তদন্তের জন্য একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে। তিনি তথ্য-উপাত্ত দেখে তদন্তের পর প্রতিবেদন দাখিল করবেন।’
মামলার বিষয়ে কথা বলতে আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাবার হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।’
কী ঘটেছিল ভারতে
২০২৪ সালের ১১ মে ভারতে গিয়ে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম ওঠেন তার বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বরানগরের বাড়িতে। চিকিৎসা করাতে যাবেন বলে পরের দিন ১২ মে গোপালের বাড়ি থেকে বের হন আনার। ওইদিন রাতেই নিউ টাউনের বহুতল আবাসন সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে তাকে হত্যা করা হয়।
বিষয়টি প্রকাশ পায় ১০ দিন পর। ২২ মে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এমপি আনারকে কলকাতার এক বাড়িতে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
পরে ভারতীয় পুলিশের দেওয়া তথ্যে বাংলাদেশের পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের হোতা আক্তারুজ্জামান শাহীন নেপালের কাঠমান্ডু হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন বলে পুলিশের তরফে বলা হয়।
মামলাটি ডিবি থেকে সিআইডিতে এসেছে। সিআইডির ঢাকা পশ্চিম বিভাগ মামলাটি তদন্ত করবে। এ মামলার তদন্তের জন্য একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে। তিনি তথ্য-উপাত্ত দেখে তদন্তের পর প্রতিবেদন দাখিল করবেন।-সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কলকাতার পুলিশ জিহাদ হাওলাদার নামে এক কসাইকে গ্রেফতার করে। আর শাহীনের সহকারী সিয়াম হোসেন কাঠমান্ডুতে গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করে নেপালের পুলিশ।
জিজ্ঞাসাবাদে সিয়ামের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাকে নিয়ে ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজার থানা এলাকার কৃষ্ণমাটিতে বাগজোলা খালে নামে কলকাতার সিআইডি। পরে একটি ঝোপের পাশ থেকে বেশ কিছু হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়।
কলকাতার সিআইডি পুলিশের বরাত দিয়ে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ১৩ মে সঞ্জীবা গার্ডেনে আনারকে হত্যা করে হাড়-মাংস টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়। তার কিছু অংশ টয়লেটে ফেলে ফ্লাশ করা হয়। বাকি অংশ সুটকেসে ভরে বাগজোলা খালে ফেলে দেন সিয়াম। সঙ্গে ছিলেন এই মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত জিহাদ হাওলাদার। খালে মাংস ফেলে আবার নিউ টাউনের বাসায় ফিরে যান সিয়াম।
এর আগে কলকাতার ওই বাড়ির সেপটিক ট্যাংক থেকেও মাংসের টুকরা উদ্ধারের কথা জানায় পুলিশ। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সেগুলো ভারতের কেন্দ্রীয় ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়। প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানানো হয়, উদ্ধার করা মাংসের টুকরা ও হাড়গোড় পুরুষ মানুষের।
সেসব দেহাংশের ডিএনএ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আনারের মেয়েকে ভারতে গিয়ে নমুনা দিতে বলা হয়। কলকাতা পুলিশের আহ্বানে নভেম্বরের শেষ দিকে কলকাতা যান ডরিন। তখন তার ডিএনএর নমুনা নেওয়া হয়। তারপর দুটি নমুনা যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হয় সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে।
কলকাতা পুলিশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে ডিসেম্বরে হিন্দুস্থান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিএনএ প্রতিবেদনে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে কলকাতার ফ্ল্যাট আর খালপাড় থেকে যে মাংস ও হাড় উদ্ধার করা হয়েছিল, তা বাংলাদেশের এমপির। তবে সেই প্রতিবেদন এখনো বাংলাদেশ পুলিশের হাতে না আসায় আটকে আছে ডরিনের করা মামলার তদন্ত।
পশ্চিমবঙ্গের মামলায় গত বছরের আগস্টে উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাত জেলা আদালতে প্রায় ১২শ পাতার চার্জশিট জমা দেয় কলকাতার সিআইডি। জিহাদ হাওলাদার ও মোহাম্মদ সিয়ামকে আসামি করে দেওয়া ওই অভিযোগপত্রে আনারকে হত্যার আগে এবং পরের ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ তুলে ধরা হয়।
টিটি/এএসএ/এমএফএ/এএসএম