রাজশাহীর পদ্মা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন রোধ, চরাঞ্চলের দুর্গত মানুষদের জরুরি সেবা এবং নৌ দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধারকাজে কয়েক বছর আগে নৌ পুলিশের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় একটি স্পিডবোট। বর্তমানে সেটি প্রায় অচল অবস্থায় পড়ে আছে। তবে স্পিডবোট না চললেও এটি পরিচালনার জন্য প্রতি মাসে প্রায় ২০০ লিটার জ্বালানি তেলের বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—যখন বোট চলে না, তখন এই তেল যায় কোথায়?
রাজশাহী নৌ পুলিশের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের আগস্টে তাদের জন্য একটি স্পিডবোট বরাদ্দ দেওয়া হয়। বোটটি চালানোর জন্য নিয়মিতভাবে প্রতি মাসে ২০০ লিটার তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রথম দিকে বোটটি কিছুটা চললেও গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে একেবারেই অচল হয়ে আছে।
সম্প্রতি রাজশাহীর টি-বাঁধ এলাকায় নৌঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি স্পিডবোটের মাঝে নৌ পুলিশের একটি স্পিডবোট দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে। স্থানীয়রা বলছেন, গত কয়েক মাসে বোটটিকে নদীতে নামতে দেখেননি তারা।
টি-বাঁধ এলাকার বাসিন্দা আনিসুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিসি স্যারের স্পিডবোট, বিজিবির স্পিডবোট—সবগুলোই নিয়মিত চলতে দেখি। কিন্তু নৌ পুলিশের বোটটিকে কোনোদিন নদীতে নামতে দেখিনি। আগে সামান্য চলতো, এখন একেবারেই অচল।’
চরাঞ্চলের মানুষও একই অভিযোগ তুলেছেন। তাদের দাবি, বন্যা বা দুর্ঘটনার সময় পুলিশের এ স্পিডবোটের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। ফলে বিপদের সময় ভরসা করতে হয় ভাড়ায়চালিত ট্রলার বা স্থানীয় জেলেদের নৌকায়।
চার মাঝারদিয়ার বাসিন্দা এনামুল হক বলেন, ‘কয়েকদিন আগে নদীর পানি বেড়ে গিয়েছিল। তখন আমাদের খুব কষ্টে পারাপার হতে হয়েছে। কিন্তু পুলিশের এই স্পিডবোট কোনো কাজে লাগেনি।’
নৌ পুলিশ কর্তৃপক্ষের দাবি, স্পিডবোটটি নিয়মিত নদীতে টহল দেয়। তবে এ বিষয়ে প্রমাণ হিসেবে থাকা লগবুক দেখতে চাইলে শুরু হয় লুকোচুরি। সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে টি-বাঁধ এলাকায় নৌ পুলিশ ইনচার্জ উজ্জ্বল হোসেনকে লগবুক দেখাতে বললে তিনি জানান, নামাজ শেষে অফিসে এলে তা দেখাবেন। পরে ফাঁড়িতে গিয়ে লগবুক চাইলে তিনি প্রথমে বলেন, ‘এটি স্পিডবোট চালকের কাছে আছে, তবে চালক বাইরে আছে।’
ফোন করে ডাকতে বলা হলে তিনি বাইরে গিয়ে স্পিডবোট চালকের ফোনে কথা বলেন। কয়েক মিনিট পর স্পিডবোট চালক ফাঁড়িতে আসেন। আসার পর তার কাছে জানতে চাওয়া হলে ‘এটি এসপি অফিসে আছে’ বলে জানান। এরপর প্রতিবেদক এসপি অফিসে গেলে নৌ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলে এলাহি জানান, লগবুক ঢাকার লজিস্টিকস অ্যান্ড ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট শাখায় রয়েছে।
পরে ঢাকার সংশ্লিষ্ট শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারকে কল করা হলে তিনি জানান, এটি ঢাকায় থাকার কথা নয়। সংশ্লিষ্ট ইউনিটেই এটি থাকার কথা।’ পরে অবশ্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দাবি করেন, এটি নৌ পুলিশ ইউনিটের কাছেই আছে।
এক পর্যায়ে রাজশাহী সংশ্লিষ্ট ইউনিটের ইনচার্জ (আরএমপি নৌপুলিশ ফাঁড়ি) উজ্জ্বল হোসেনকে পুনরায় প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘কোনো অনিয়ম পেলে নিউজ করবেন’। লগবই আসলে কোথায় আছে নির্দিষ্টভাবে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর না দিয়ে কল কেটে দেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরাদ্দের তেল আসলে স্পিডবোটে ব্যবহার হচ্ছে না। বিভিন্ন সূত্র বলছে, এই তেল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কাজে বা অন্য যানবাহনে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে নৌ পুলিশের ভেতরেও নানা কানাঘুষা চলছে।
নৌ পুলিশের লজিস্টিকস অ্যান্ড ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এসপি কে এম আরিফুল হক বলেন, ‘সব স্পিডবোট সচল আছে। এগুলো চালানোর জন্য সরকারই খরচ বহন করে। এর বাইরে বিস্তারিত বলতে পারবেন সংশ্লিষ্ট ইউনিট প্রধান।’
রাজশাহী নৌ পুলিশের পুলিশ সুপারের বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে সম্প্রতি তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘স্পিডবোটের তেল আমরা ভাড়ায় নেওয়া নৌকায় ব্যবহার করি।’
এসআর/এএসএম