বদরুদ্দীন উমর: এক বামপন্থী চিন্তাবিদ ও বিপ্লবী রাজনীতিক

1 day ago 4

বদরুদ্দীন উমর একজন চিন্তাশীল, আদর্শনিষ্ঠ এবং আপসহীন রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি ভারতের বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করনে। ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি ভারতের বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবুল হাশিম ছিলেন একজন বিশিষ্ট মুসলিম লীগ নেতা ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সংগঠক।

পঞ্চাশের দশকে তার বাবা ঢাকায় ‘খেলাফত-ই-রব্বানী পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ইসলামী আদর্শ বাস্তবে রূপায়িত করাই ছিলো এ দলের আদর্শ। পারিবারিক রাজনৈতিক কারণেই শুরুতে ইসলামী চিন্তাধারায় প্রভাবিত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই বদরুদ্দীনের চিন্তায় বাঁক আসে। পরবর্তীকালে তিনি কমিউনিস্ট রাজনীতির মৌলিক চিন্তাধারা বহন ও প্রচার করেছেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম মার্ক্সসবাদী দার্শনিক।

২০২১ সালে এক সাক্ষাৎকারে বদরউদ্দির উমর বলেন, ‘প্রথম জীবনে পিতার প্রভাবে এক ধরনের ইসলামী চিন্তার আচ্ছন্নতা ছিল। যে কারণে ঢাকায় আসার পরও তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলাম। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে তা কাটতে শুরু করে। তারপর অক্সফোর্ডে যাওয়ার পর মার্কসবাদী চিন্তা-ভাবনা পূর্ণতা পায়। সেখানে থাকার সময় আমি তৎকালীন বিশ্বের সব ধরনের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করেছি।’

১৯৫০ সালে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন এবং ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৩ সালে দর্শনে স্নাতক ও ১৯৫৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলোসফি, পলিটিক্স ও ইকোনমিক্স বিষয়ে স্নাতক শেষ করনে। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে তার পেশাজীবনের শুরু। এরপর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন এবং ১৯৫৭ সালে যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই তিনি সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে ১৯৬৮ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে পূর্ণকালীন রাজনীতিতে যুক্ত হন। ২০০৩ সালে গঠন করেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, যার সভাপতির দায়িত্ব তিনিই পালন করেন।

বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান মার্কসবাদী চিন্তাবিদ, লেখক ও সম্পাদক। তার রচিত ও সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। ভাষা আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা, সংস্কৃতি ও বাম রাজনীতি নিয়ে তার কাজগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (তিন খণ্ডে), সাংস্কৃতিক সংকট, সাম্প্রদায়িকতা, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি।

তিনি দীর্ঘ ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে সংস্কৃতি নামে একটি রাজনৈতিক সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন এবং গণকণ্ঠ ও হলিডে পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের দৃষ্টিভঙ্গি সবসময়ই ছিল তীক্ষ্ণ, বিশ্লেষণধর্মী ও স্পষ্ট। তিনি বিশ্বাস করতেন সামাজিক পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যখন জনগণের নিজস্ব শক্তির ভিত্তিতে সংগঠিত আন্দোলন গড়ে ওঠে। কিন্তু ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘৫ আগস্টের পর জামায়াতে ইসলামী শক্তিশালী হয়েছে। এখন দক্ষিণপন্থীদের প্রভাব বেড়েছে। তাদের একটা উত্থান হয়েছে এখন। ছাত্রদের নেতৃত্বে যে পার্টি হয়েছে, সে পার্টির বক্তব্যে শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষ নিয়ে কোনো কথা নাই। তারা ভাবছে ধর্মকে ব্যবহার করবে। সে জন্য তাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।’

বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘ছাত্রদের নেতৃত্বে যে আন্দোলন হয়েছে, সেটা যে একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সে রকম কিছু নয়। গণ–অভ্যুত্থান যেটা বলা হচ্ছে, সেটা আসলে একটা বিস্ফোরণের মতো ব্যাপার। একটা হলো দীর্ঘদিনের গণ–আন্দোলনের শীর্ষে গিয়ে একটা অভ্যুত্থান, আরেকটা হলো কোনো আন্দোলন করতে না পেরে দীর্ঘদিনের একটা ক্ষোভ ধামাচাপা থাকার ফলে একটা পরিস্থিতি। বাংলাদেশে দ্বিতীয় ধরনের অবস্থা তৈরি হয়েছিল।’

২০২৪ সালের পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকার ও লেখায় উমর বলেন, গণআন্দোলনের অগ্রযাত্রা তখনই বাধাপ্রাপ্ত হয়, যখন এর নেতৃত্ব আদর্শহীন হয়ে পড়ে অথবা সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী তাতে প্রবেশ করে। তিনি বলেন, এ দেশে কোনো আন্দোলন দীর্ঘমেয়াদে টিকতে পারে না, যদি তা শ্রেণিসচেতন নেতৃত্বের হাতে না থাকে। কেবল স্লোগান দিয়ে ক্ষমতার কাঠামো ভাঙা যায় না।

বদরুদ্দীন ওমর তার লেখনি ও বক্তব্যে বারবার কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন—যাদের ওপর গড়ে ওঠা সংগঠিত আন্দোলনই সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রকৃত পথ হতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।

এই কারণে, উমরের কাছে জাতীয় মুক্তি মানেই কেবল ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান নয়, বরং সব ধরনের শ্রেণি শোষণ, ধর্মীয় বিভাজন, এবং সংস্কৃতির ওপর দখলের বিরুদ্ধে একটি ঐতিহাসিক সংগ্রাম।

বদরুদ্দীন উমর নীতিগত কারণে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার গ্রহণে সবসময় বিরত থেকেছেন। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০২৫ সালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষিত স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।

নিজের বিবৃতিতে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ‘১৯৭৩ সাল থেকে আমাকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে। আমি সেগুলোর কোনোটি গ্রহণ করিনি… এখন বর্তমান সরকার আমাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দিতে চাইলেও, সেটিও গ্রহণ করা সম্ভব নয়।’

বাংলাদেশের রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা বিতর্কিত ব্যাখ্যা ও তীব্র সমালোচনার জন্য পরিচিত বামপন্থী বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর বিভিন্ন সময়ে বাম রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা নিয়ে নানা মন্তব্য করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের বিষয়ে সমালোচনা করে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ফ্যাসিবাদই ছিল মুজিবের জাতীয়তাবাদ।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও এর ইতিহাসচর্চা নিয়েও তিনি ছিলেন সমালোচনামুখর। এক বক্তব্যে তিনি বলেন, বর্তমান রাষ্ট্রীয় ইতিহাসচর্চা অনেকাংশেই রাজনৈতিক পুরস্কার নির্ভর এবং কৃত্রিমভাবে তৈরি করা। তাঁর মতে, এটি রাষ্ট্রীয় রণনীতির অংশ হিসেবে গড়ে ওঠা একটি ‘পুরস্কার-সৃষ্ট ইতিহাস।’

বাম রাজনীতির ভূমিকাও তাঁর সমালোচনার বাইরে ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের অংশগ্রহণ নিয়ে ওমর বলেন, ‘অনেকে বামপন্থী বলে পরিচিত হলেও আদর্শগতভাবে প্রকৃত বামপন্থী ছিলেন না। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল সীমিত।’

জেপিআই/এমএমকে/জিকেএস

Read Entire Article