বিএমইটি থাকতেও বিদেশগামীদের অধিকাংশই অদক্ষ

4 days ago 14

দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন প্রবাসীরা। কিন্তু বিদেশে দক্ষ কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। দেশে বিদেশগামীদের দক্ষ করতে টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) থাকলেও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই। অর্ধেকের বেশি শ্রমিক যাচ্ছেন অদক্ষ হিসেবে। ফলে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি রিসার্চ মুভমেন্টসের (রামরু) এক প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছেন ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৯ জন। তাদের মধ্যে দক্ষ কর্মীর সংখ্যা মাত্র দুই লাখ ১৪ হাজার ৪৪ জন, যা মোট শ্রমবাজারের ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। একই সময়ে স্বল্পদক্ষ কর্মী (অদক্ষ) হিসেবে বিদেশে গেছেন চার লাখ ৯১ হাজার ৪৮০ জন বা ৫৪ দশমিক ২৩ শতাংশ।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জনশক্তি রপ্তানির অর্ধেকের বেশি অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ কর্মী হিসেবে বিদেশে যাচ্ছেন। এছাড়া আধা-দক্ষ কর্মী হিসেবে বিদেশে গেছেন এক লাখ ৫৯ হাজার ১২৮ জন বা ১৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, পেশাজীবী হিসেবে পাড়ি জমিয়েছেন ৪১ হাজার ৬২১ জন, যা মোট শ্রমবাজারের চার দশমিক ৫৯ শতাংশ।

আমাদের ট্রেনিং সেন্টার মান্ধাতা আমলের। এগুলো সব পলিটিক্যাল। বিগত সময়ে মন্ত্রী, সচিবরা নিজ এলাকায় বানিয়েছেন। সেখানে না আছে ট্রেনিং ফ্যাসিলিটিজ, না আছে দক্ষ ট্রেইনার। যেসব ট্রেনিং দেওয়া হয় সেটাও ফলপ্রসূ হয় না।- অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির

বিদেশগামী কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) আওতায় পরিচালিত ১১০টি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তৈরি হচ্ছে না যুগোপযোগী দক্ষ কর্মী।

৫ বছরে ৪ লাখ কর্মী প্রশিক্ষণ দিয়েছে বিএমইটি

জনশক্তি কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ পাঁচ বছরে বিএমইটির ট্রেনিং সেন্টারগুলোর মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছেন চার লাখ ১২ হাজার ৫০৪ জন কর্মী। এর মধ্যে ২০২০ সালে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ৩৬ হাজার ৯৮৬ জন, ২০২১ সালে ৫২ হাজার ৯২১, ২০২২ সালে ১ লাখ ১৩ হাজার দুই, ২০২৩ সালে ১ লাখ ৮ হাজার ৯১ ও ২০২৪ সালে এক লাখ এক হাজার ৫০৪ জন।

জানা যায়, এই ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (মেরিন ও শিপবিল্ডিং টেকনোলজি), দুই বছর মেয়াদি সার্টিফিকেট কোর্স, এসএসসি ভোকেশনাল, স্বল্পমেয়াদি কোর্স (ছয় মাস মেয়াদি ইলেকট্রনিক্স, রেফ্রিজারেটর, ড্রাইভিং, ওয়েল্ডিং)। দেশ-বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ, ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্স, হাউজ কিপিং কোর্স প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

তবে এসব ট্রেনিং সেন্টার থেকে ট্রেনিং নিয়ে ঠিক কতজন বিদেশ যায়, সে তথ্য নেই টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারগুলোর কাছে। টিটিসি থেকে দেওয়া প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশগামীরা ঠিক কতটা দক্ষ হচ্ছে সেগুলো নিয়েও উঠেছে নানাবিধ প্রশ্ন।

আমাদের এখানে চার ধরনের পেশায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এজেন্সিগুলো কখনোই আমাদের কাছে চাহিদা দেয় না যে আমাদের দক্ষ লোক লাগবে। এখান থেকে প্রশিক্ষিত হয়ে অনেকেই যাচ্ছে, কিন্তু সবার তথ্য আমাদের রাখা সম্ভব হয় না।- বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ লুৎফুর রহমান

বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী দেশে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে না। ট্রেইনার ও যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। ফলে বিদেশে পাঠানোর মতো দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে পারছে না বাংলাদেশ। বিএমইটির পলিসি মেকিংয়ে ঘাটতি রয়েছে।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির জাগো নিউকে বলেন, ‘আমাদের ট্রেনিং সেন্টার মান্ধাতা আমলের। এগুলো সব পলিটিক্যাল। বিগত সময়ে মন্ত্রী, সচিবরা নিজ এলাকায় বানিয়েছেন। সেখানে না আছে ট্রেনিং ফ্যাসিলিটিজ, না আছে দক্ষ ট্রেইনার। যেসব ট্রেনিং দেওয়া হয় সেটাও ফলপ্রসূ হয় না।’

তিনি বলেন, ‘টিটিসিগুলো বাইরের মার্কেট অনুযায়ী যুগোপযোগী কাজ শেখাতে পারে না। এগুলো আমাদের দেশের কাজের জন্যই দক্ষ করে তুলতে পারে না, বাইরের দেশে তো দূরের কথা। পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে গত কয়েক বছরে শুধু ভবনই উঠেছে। দক্ষ শ্রমিক তৈরি হয়নি। ভালো প্রশিক্ষকও তৈরি হয়নি। অথচ সরকার চাইলে বিদেশি শ্রমবাজার উপযোগী শ্রমিক তৈরি করতে পারে। প্রয়োজনে প্রফেশনাল ট্রেইনার আনতে পারে।’

সরকারের প্রকল্প মনিটরিংয়ের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক মূল্যায়ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, টিটিসিগুলোর নানা অনিয়ম রয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে বিদেশে যেতে পেরেছেন মাত্র ৮-১২ শতাংশ প্রশিক্ষণার্থী। দেশে কাজ পেয়েছেন ১৫-২০ শতাংশের মতো। বাকি ৭০ শতাংশই কাজ না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত। সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কোর্স করলেই চাকরি—এমন আশা বাস্তবে না মেলায় বিদেশগামী তরুণরা টিটিসিমুখী হন না।

প্রশিক্ষণ কোর্সগুলোর পরিকল্পনা ২০০৯ সালে করা হলেও সময়ের সঙ্গে আধুনিকায়ন ও বাজারের চাহিদাভিত্তিক না হওয়ায় তা কোনো কাজে আসছে না বলে জানিয়েছে আইএমইডি। ব্যবহারিক শিক্ষা না দিয়ে বাতিল যন্ত্রপাতির মাধ্যমে এসব প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে চাকরির আশাকে ‘উচ্চাভিলাষী’ বলছে সংস্থাটি।

ট্রেনিং নিয়ে দক্ষ কর্মী যে যাচ্ছে না তা নয়। আমরা হিসাব রাখতে পারি না। অনেকে এই ট্রেনিং নিয়ে দেশেই চাকরি করে। আমাদের সব সময় লক্ষ্য থাকে দক্ষ জনবল তৈরি করা। তারা কাজ শিখে যেতে পারে। তিন, ছয় বা এক বছর ট্রেনিং করে কেউ দক্ষ হতে পারে না।- জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর প্রশিক্ষণ পরিচালক সালাহ উদ্দীন

এছাড়া টিটিসির প্রশিক্ষণ আন্তর্জাতিক চাহিদা মেটাতে পারছে না বলে জানায় আইএমডি। সরকারের ১৮টি টিটিসির এক হাজার ৮০ জনের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ২০২৩ সালে প্রতিবেদনটি তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি।

এদিকে টিটিসিগুলোর পরিচালকরা বলছেন, লোকবল সংকট আর ট্রেইনার সংকটের কারণে প্রশিক্ষণ পরিচালনায় নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কখনোই ট্রেনিং সেন্টারকে দক্ষ লোকের চাহিদা দেয় না।

বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ লুৎফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এখানে চার ধরনের পেশায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এজেন্সিগুলো কখনোই আমাদের কাছে চাহিদা দেয় না যে আমাদের দক্ষ লোক লাগবে। এখান থেকে প্রশিক্ষিত হয়ে অনেকেই যাচ্ছে, কিন্তু সবার তথ্য আমাদের রাখা সম্ভব হয় না। এজেন্সিগুলো তো যারে তারে ধরে পাঠায়। তারা দক্ষ শ্রমিক পাঠায় না। তারা যদি যাচাই-বাছাই করে দক্ষ শ্রমিক নেয়, তখন স্কিল মাইগ্রেশন হবে।’

নোয়াখালী কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ওয়ালিউল্লা মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিটি সেক্টরে কাজ শেখানোর জন্য লোক দরকার দুজন করে। আমাদের আছে একজন করে। এসব সমস্যা দীর্ঘদিনের। আরেকটা বিষয় হলো, এজেন্সির প্রতারণার কারণে এখান থেকে যারা প্রশিক্ষণ নেয়, তারা এজেন্সির মাধ্যমে অনেক সময় যেতে চায় না। অনেকে সরকারিভাবে বিনা খরচে যেতে চায়। তাই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের যাওয়ার সংখ্যা কম মনে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘বিদেশ যেতে ইচ্ছুক অনেকে ভাষাও শিখতে চায় না। বিদেশের ক্ষেত্রে ভাষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের শ্রমিকদের কাজ কিংবা ভাষা না শিখে যাওয়ার প্রবণতাকে আমি মনোজাগতিক সমস্যা হিসেবে দেখি। আর যারাই ভালো করে ট্রেনিং নেয়, তাদের দেশে কিংবা বিদেশে জব হয়। বিদেশ যেতে না পারলেও দেশে জব করে।’

যা বলছে বিএমইটি

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর প্রশিক্ষণ পরিচালক সালাহ উদ্দীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের কাজ তো ট্রেনিং দেওয়া। এখন এখান থেকে কতজন যাচ্ছে সেই হিসাব তো আমরা রাখি না।’

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘একটা শিক্ষার্থী ভার্সিটি থেকে পাস করে বের হলে ভার্সিটি কিন্তু তালিকা করে না যে সে শিক্ষার্থী জব করে কি করে না, আবার সেই শিক্ষার্থীও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জানায় না, জবে ঢুকছে কি না।’

তিনি বলেন, ‘বিএমইটিতে জব প্লেসমেন্ট অফিসার পোস্ট নেই। আমাদের অনেক জনবল সংকট। ৪০ নতুন টিটিসি হয়েছে, কোনো পোস্ট তৈরি হয়নি। নিয়োগও বন্ধ। উপজেলায় জনবল অনেক কম। কীভাবে চলবে। তবে সামনে আমরা তালিকা রাখবো কারা বিদেশ যায়।’

‘ট্রেনিং নিয়ে দক্ষ কর্মী যে যাচ্ছে না তা নয়। আমরা হিসাব রাখতে পারি না। অনেকে এই ট্রেনিং নিয়ে দেশেই চাকরি করে। আমাদের সব সময় লক্ষ্য থাকে দক্ষ জনবল তৈরি করা। তারা কাজ শিখে যেতে পারে। তিন, ছয় বা এক বছর ট্রেনিং করে কেউ দক্ষ হতে পারে না। তাকে আগে কাজ দিতে হবে এরপর সে কাজ করে দক্ষ হয়ে উঠবে।’যোগ করেন সালাহ উদ্দীন

রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘দেশের এজেন্সিগুলো মধ্যপ্রাচ্য থেকে দক্ষ শ্রমিকের ডিমান্ড আনতে পারে না। তারা আমাদের কাছে লোকবল চায় না। বরং আমরাও দক্ষ শ্রমিক পাঠাই। স্কিল মাইগ্রেশন নিয়ে কাজ করি। সেটা আইএম জাপান, কোইকাসহ বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে।’

যা বলছে বায়রা

রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা দক্ষ, অদক্ষ ও সেমি দক্ষ শ্রমিক পাঠাই। কথা হচ্ছে টিটিসি যে ট্রেনিং দেয়, এটা সার্টিফিকেটধারী। অভিজ্ঞতার নিশ্চয়তা দেয় না। কারণ আমাদের নিয়োগকর্তারা এসে আগে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা দেখে। আর টিটিসি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ ইন্টার্নিও করে না। এই ট্রেনিং নিয়ে বিদেশ যাওয়ার মতো দক্ষ হয় না। বাইরের সঙ্গে ম্যাচ হতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘রিক্রুটিং এজেন্সি ও টিটিসি কানেক্টিভিটি বাড়াতে হবে। টিটিসি কিন্তু সার্কুলার দিতে পারে, যে তাদের হাতে এত হাজার বিভিন্ন সেক্টরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী রয়েছে। তখন এজেন্সিগুলো সেখান থেকে আবেদন গ্রহণ করতে পারবে। এসব নিয়ে বাস্তবমুখী চিন্তা করতে হবে।’

আরএএস/এএসএ/জেআইএম

Read Entire Article