বিদেশেও খ্যাতি ছড়িয়েছে বগুড়ার ‘কটকটি’

3 months ago 101

বগুড়ার মহাস্থানের ঐতিহ্যবাহী একটি খাবারের নাম ‘কটকটি’। এটি খয়েরি রঙের ছোট আকৃতির মিষ্টি জাতীয় খাবার। চালের আটা আর তেলের মিশেলে তৈরি খাবারটি মুখে দিলেই কড়মড় শব্দে গলে যায়। পর্যটকদের মাধ্যমে এ খাবারের খ্যাতি ছড়িয়েছে বিদেশেও।

স্থানীয়রা জানান, স্থানীয়ভাবে তৈরি এক ধরনের শুকনো খাবার হিসেবে পরিচিত ছিল কটকটি। যা স্থানীয় মাজারে আসা ভক্তরা সিন্নি হিসেবে গ্রহণ করতেন। চালের আটা দিয়ে তৈরি এ খাবারটি প্রথমে রোদে শুকানো হতো। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৌশল বদলেছে। এখন এটি তেলে ভেজে প্রস্তুত করা হয়। তবে পরিবর্তন আসলেও কটকটির মূল স্বাদ ও ঐতিহ্য রয়েছে এখনো।

কটকটি তৈরিতে সুগন্ধি চালের পরিবর্তে ৩৩ জাত এবং মামুন জাত (বিশেষ ধরনের মোটা চাল) ব্যবহার করা হয়। সঙ্গে গুড় ও পামওয়েল ব্যবহার হয়। এ কটকটি কিছুটা শক্ত হয়। আর সেরা মানের কটকটি তৈরিতে ডালডা, কালিজিরা, তেজপাতা, ঘি ও বাদাম ব্যবহার করা হয়। এটি পণ্যটিকে নরম, সুস্বাদু ও মচমচে করে তোলে।

বিদেশেও খ্যাতি ছড়িয়েছে বগুড়ার ‘কটকটি’

কটকটি তৈরি করে ওই এলাকার হাজারো মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৫০-৬০টি কারখানায় তৈরি হয়। সেখানে চার শতাধিক নারী-পুরুষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। সবচেয়ে আশার কথা এখানকার নারীরা কারিগর হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে পরিবারে সচ্ছলতা এনেছেন।

এ এলাকায় বড় দোকানগুলোর মধ্যে নসিব কটকটি, হামু মামার কটকটি, নাসির কটকটি দোকান সবসময় খোলা থাকে। প্রকারভেদে ১৪০ থেকে ২৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয় কটকটি। তবে ঘিয়ের ফ্লেবার দেওয়া শাহী কটকটির কেজি ৩০০ টাকা।

বিদেশেও খ্যাতি ছড়িয়েছে বগুড়ার ‘কটকটি’

কাজলি বেগম একজন নারী শ্রমিক। তিনি দীর্ঘ ২৫-৩০ বছর ধরে এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলেন, ‘বিশ বছর আগে দিনে ৬০ টাকা মজুরি পেতাম। এখন দিনে ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা পাই। তবে বিশেষ দিনে এ মজুরি ওভারটাইমসহ ৬০০-৭০০ টাকা হয়ে যায়। এখন আমার সংসারে আর অভাব নেই। প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা উপার্জন করে ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষিত করার চেষ্টা করছি।’

আঙ্গুরি বেগম ৪ বছর ধরে কটকটি তৈরির কারখানায় কাজ করছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে ঢেঁকিতে কুটতাম। এখন কটকটি বানাই। ৪২০ টাকা মজুরি পাই। আমি এতেই সন্তুষ্ট। পরিবারসহ ভালভাবেই চলতে পারছি।’

এ ধরনের কটকটি শিল্পে কাজ করার মাধ্যমে নারীরা একদিকে যেমন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করেছে, তেমনি তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের উচ্চ শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

এ কটকটি শুধু স্থানীয় বাজারেই বিক্রি হয় না। এখন দেশের নানা অঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে। সাধারণ সময়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০ মণ কটকটি উৎপাদিত হয়। যার বাজারমূল্য গড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। বিশেষ দিনে (মেলা, ঈদ) কটকটি বিক্রির পরিমাণ ৩০০ থেকে ৪০০ মনে গিয়ে দাঁড়ায়।

বিদেশেও খ্যাতি ছড়িয়েছে বগুড়ার ‘কটকটি’

নসিব কটকটি ঘরের মালিক নসিব বলেন, ‘কটকটি শিল্প শুধু মহাস্থানগড়ের ঐতিহ্য নয়, এটি পুরো বগুড়া জেলার কর্মসংস্থান। ব্যবসা ও সৃজনশীলতার এক নতুন দ্বার উন্মুক্ত করেছে। এর স্বাদ হাজারো মানুষের জীবনে নতুন রঙ ছড়াচ্ছে। শীত-গরম উভয় সিজনে তার পণ্যে চাহিদা থাকে বেশ।’

লাল মিয়া কটকটি ঘর মালিক লাল মিয়া বলেন, ‘কয়েক বছরের মন্দাভাব কাটিয়ে এখন জমজমাট ব্যবসা হচ্ছে। শুধু বৈশাখের শেষ বৃহস্পতিবারের মেলাতে তিনি একাই ৩০০০ হাজার কেজি কটকটি দুপুরের মধ্যেই বিক্রি করেছেন। ছোট ব্যবসায়ী সুলতান কটকটি বিক্রি করেছে ৮০ মন।’

হামু মামা কটকটি প্যালেস দোকানের মালিক হামিদুল ইসলাম হামু বলেন, ‘শুরুতে কটকটি মজার খাবার হিসেবে বিক্রি করতাম। কিন্তু এখন দেখি এটি এলাকার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শিল্পটি আমাকে শুধু ব্যবসায়িক লাভই দেয়নি, পাশাপাশি এলাকার মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কটকটি এখন শুধু বগুড়া জেলার মধ্যে নয়, দেশের অন্যান্য অঞ্চল, শহর, এমনকি শপিংমলে বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় দোকান ছাড়াও সারাদেশের হাটবাজারেও এটি জনপ্রিয় একটি খাদ্যদ্রব্য। কটকটি শিল্পের আরও উন্নয়ন ও বিস্তার করতে হলে সরকারি সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিল্পটি যদি আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং এবং ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে আরও উন্নতি হয় তাহলে এটি আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছাতে পারে। এটি শুধু ঐতিহ্য নয়, একটি সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র শিল্প বলা চলে। সরকারি এসএমই প্রকল্পের সহায়তা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং সহজ ঋণ সুবিধা পেলে এ কটকটি শিল্প আরও বিস্তৃত হবে।‘

এলবি/আরএইচ/জেআইএম

Read Entire Article