সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট বিভুরঞ্জন সরকারের বয়স পঞ্চাশের নিচে হলে হয়তো ‘আত্মহত্যা’ করতেন না। হয়তো চেষ্টা করতেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে। শরীরের শক্তি ও মনোবল দিয়ে সৎভাবে জীবনযাপনের চেষ্টাটা চালিয়ে যেতেন।
বিভুরঞ্জন আমার বাবার বয়সী। বাবার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবেন। শুক্রবার বিকালে তার মৃতদেহের ছবিটা যখন একজন সহকর্মী হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালেন, তখন অনেক ভাবনার ভিড়ে আব্বার চেহারাটাও চোখে ভেসে ওঠে। শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসরে যাওয়ার বছর দুই আগে থেকেই তাকে দেখেছি কী ভীষণ দুশ্চিন্তা! মনে মনে হয়তো ভাবতেন, অবসরের পরে কী করবেন। পেনশনেই বা কত টাকা পাবেন আর সেই টাকা দিয়ে কীই বা করা যাবে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামীর সংসারে তার মতো আছে। ছোট মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ভরসা কেবল ছেলে। সে কতটা খেয়াল রাখবে—এইসব ভাবনা হয়তো তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
৭২ বছরের গড় আয়ুর দেশে ৬০ বছর খুব বেশি না হলেও, জীবিকার দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তাবোধ একজন শারীরিকভাবে সক্ষম ও সম্মানিত অধ্যক্ষকেও কী করে বৃদ্ধ বানিয়ে দেয়, তার বড় উদাহরণ আমার ঘরে। যদিও একমাত্র ছেলে হিসেবে বাবার প্রতি দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি—নানা সীমাবদ্ধতা ও জটিলতার ভেতরেও। কিন্তু এই ভদ্রলোকের যদি একজন কর্মক্ষম এবং উপার্জনকারী ছেলে না থাকতো—কে তাকে দেখতো, রাষ্ট্র? একজন মানুষ ৩০ বছর সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান ও মূল্যবোধের আলো ছড়িয়ে অবসরের যাওয়ার পরে কী খাবেন—এই দুর্ভাবনা তার মাথায় কেন আসবে? এই দেশের মানুষ যে ছেলেসন্তানের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে, তার জন্য প্রধানত দায়ী বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়ের ভরণপোষণের দুশ্চিন্তা।
সরকারি স্কুলকলেজ বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক অবসরে যাওয়ার পরে যে পরিমাণ পেনশন ও অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পান, বেসরকারি শিক্ষকদের বেলায় সেই অঙ্কটা অনেক ছোট। বড় পরিবার হলে অধিকাংশ শিক্ষককেই কর্মজীবনে প্রচুর ধারদেনা করতে হয়। অনেকের পেনশনের টাকা শেষ হয়ে যায় ওই দেনা শোধ করতে।
সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরে যাওয়ার পরে রাষ্ট্রের যে ব্যবস্থাপনাটি আছে, বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় সেটি মন্দ নয়। কিন্তু বেসরকারি চাকরিজীবীদের কী হবে? অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই পেনশন নেই, প্রভিডেন্ট ফান্ড বা অন্যান্য আর্থিক সুরক্ষা নেই। অধিকাংশকেই ফিরতে হয় শূন্য হাতে।
সমাধান হলো গণমাধ্যমে পেশাদারি প্রতিষ্ঠার লড়াই। গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির আইনি সুরক্ষা ও পেনশন চালুর দাবি দীর্ঘদিনের। দুয়েকটা পত্রিকা ওয়েজবোর্ড মানলেও সেখানেও আছে নানারকম ফাঁকিবাজি। টেলিভিশন ও অনলাইন পোর্টালে তাও নেই। একজন মানুষ বছরের পর বছর কাজ করে যখন প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেন, তখন তাকে ফিরতে হয় শূন্য হাতে। এরকম অমানবিক পেশা পৃথিবীতে খুবই কম আছে। - আমীন আল রশীদ
গণমাধ্যমকর্মীদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। হাতেগোণা দুয়েকটি প্রতিষ্ঠান ওয়েজবোর্ড মানলেও অধিকাংশই কোনো নিয়মি-নীতির ধার ধারে না। মাসের পর মাস বেতন বন্ধ। বেতন অনিয়মিত। পাওনা টাকা কবে পাবেন, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। উপরন্তু সাংবাদিকের বয়স যত বাড়ে, তার চাকরির ঝুঁকি তত বাড়ে। কাজের সুযোগ তত সংকুচিত হয়। ফলে খুব ব্যতিক্রম না হলে পঞ্চাশ বছর পার হলেই তাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ কাজ করে। বিকল্প আয়ের পথ না থাকলে বা উপার্জনক্ষম সন্তান দেখভাল না করলে কিংবা করতে না পারলে তখন ওই সাংবাদিককে প্রতিনিয়তই চাকরিচ্যুতি কিংবা আর্থিক সংকটের ভূত তাড়িতে বেড়ায়। খুব কম লোকের পক্ষেই এই মানসিক চাপ সহ্য করে টিকে থাকা সম্ভব।
বিভুরঞ্জনের আত্মহননের পরে বিষয়টি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাজন নানা কথা লিখছেন। সাংবাদিকতার মতো একটি কথিত মহান পেশার অন্ধকার দিকটিও আলোচনায় আসছে। কিন্তু এর সমাধান কী?
সমাধান হলো গণমাধ্যমে পেশাদারি প্রতিষ্ঠার লড়াই। গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির আইনি সুরক্ষা ও পেনশন চালুর দাবি দীর্ঘদিনের। দুয়েকটা পত্রিকা ওয়েজবোর্ড মানলেও সেখানেও আছে নানারকম ফাঁকিবাজি। টেলিভিশন ও অনলাইন পোর্টালে তাও নেই। একজন মানুষ বছরের পর বছর কাজ করে যখন প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেন, তখন তাকে ফিরতে হয় শূন্য হাতে। এরকম অমানবিক পেশা পৃথিবীতে খুবই কম আছে।
সুতরাং সকল গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানে কর্মীদের চাকরির সুরক্ষা, পেনশনসহ অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে সরকারকে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। প্রথমত মালিকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যমে সরকারকেও প্রণোদনাও দিতে হবে। গণমাধ্যমবান্ধব আইন করতে হবে। গণমাধ্যমের ওপর খবরদারি বন্ধ করতে হবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ যতই থাকুক, আর্থিক নিশ্চয়তা ও চাকরির সুরক্ষা পেলে গণমাধ্যমকর্মীরা ঝুঁকি নিয়েও সাংবাদিকতা করতে রাজি। কেননা ঝুঁকি জেনেই তারা এই পেশায় এসেছেন। কিন্তু তারা ঝুঁকি নেবেন অথচ বেতন পাবেন না; চাকরি ছেড়ে দিলে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরবেন—এরকম অমানবিক ও অযৌক্তিক সিস্টেমে গণমাধ্যম কখনোই গণমাধ্যম হয়ে উঠতে পারে না। সে হয় সরকারি প্রচারমাধ্যম অথবা সরকারবিরোধীদের প্রোপাগান্ডা সেল। দুটিই রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর।
বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশে বার্ধক্য ব্যবস্থাপনা বলে কিছু নেই। একজন মানুষ প্রকৃতির নিয়মেই বৃদ্ধ হবেন। তার শরীরের শক্তি ও কর্মক্ষমতা কমবে। রোগশোক তাকে আক্রমণ করবে। কিন্তু তাই বলে তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে হবে কেন? কেন তাকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হবে?
রাষ্ট্রকে এমন একটি প্রবীণবান্ধব সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেখানে একজন প্রবীণের কর্মক্ষম ছেলে না থাকলেও তাকে অন্তত খাওয়া-পরা ও চিকিৎসার খরচ নিয়ে ভাবতে হবে না। চুয়ান্ন বছরের বাংলাদেশে এই প্রত্যাশা হয়তো অনেক বড়, কিন্তু উদ্যোগটা যদি এখনই নেয়া যায়, তাহলে আজ যারা তরুণ, তাদের প্রবীণ জীবন হয়তো নিরাপদ, নির্ভার ও দুশ্চিন্তামুক্ত হবে। তাহলে হয়তো ৭০ বছর বয়সে গিয়ে কোনো সাংবাদিককে আর ‘বিভুরঞ্জন সরকার’ হতে হবে না। মেঘনায় তার লাশ ভেসে ওঠার মধ্য দিয়ে কথিত মহান পেশার কঙ্কালটিও বের হয়ে আসবে না।
বিভুরঞ্জনের করুণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের যে দায় ও দায়িত্বের প্রশ্নটি সামনে এলো, তার সুরাহা করতে না পারলে আরও অনেক বিভুরঞ্জনের লাশ হয়তো নদীতে ভেসে উঠবে। কেননা তার মতো আরও কত বয়স্ক মানুষ মগজের ভেতরে সুইসাইড নোট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন—তা কে জানে!
বাংলাদেশ প্রবীণদের অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে মূলত দুই কারণে; ১. অবসর জীবনে অধিকাংশ প্রবীণের উপার্জন থাকে না; থাকলেও তাদের অর্থ খরচের স্বাধীনতা থাকে না এবং ২. চিকিৎসা। এই দুটি জায়গাতেই রাষ্ট্রের অনেক বড় দায় ও দায়িত্ব রয়েছে। প্রবীণদের যদি অর্থ খরচের মতো সক্ষমতা থাকে এবং চিকিৎসার জন্য যদি সন্তানের ওপর তার নির্ভরতা কমিয়ে আনা যায়; যদি তাদের চিকিৎসার ব্যাপারটি কমিউনিটির ওপর ছেড়ে দেয়া; একটি প্রবীণবান্ধব কমিউনিটি মডেল তৈরি করা যায়—তাহলে কার ছেলে আছে বা নেই কিংবা কার সন্তান বিদেশে থাকে—সেটি বড় কোনো সমস্যা তৈরি করবে না।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।
এইচআর/এমএস