বিশ্ব মেরুদণ্ড দিবস ২০২৫ : মেরুদণ্ডের যত্নে সচেতন হই, সুস্থ জীবন গড়ি

19 hours ago 6

১৬ অক্টোবর পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্পাইন ডে ২০২৫। এবারের প্রতিপাদ্য “Straighten Up and Move”। মূল বার্তাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ; সোজা হয়ে দাঁড়ান, সক্রিয় থাকুন এবং মেরুদণ্ডের যত্ন নিন।

আজকের পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ মেরুদণ্ডের বিভিন্ন রোগে ভুগছেন, যেমন দীর্ঘ সময় বসে কাজ করা, ভুল ভঙ্গি, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা এবং আঘাতজনিত সমস্যা। আধুনিক জীবনযাপন স্পাইন ডিজঅর্ডারের নীরব ঝুঁকি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও এখন মেরুদণ্ডজনিত সমস্যা একটি বড় জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশে স্পাইন চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনো সীমিত, বিশেষজ্ঞ সংখ্যা অপ্রতুল এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি ব্যাপক।

মেরুদণ্ড শরীরের স্তম্ভ

মেরুদণ্ড শুধু আমাদের শরীরকে সোজা রাখে না, এটি মস্তিষ্ক থেকে শরীরের প্রতিটি অংশে স্নায়ু সংকেত পৌঁছে দেয়। তাই মেরুদণ্ডে সামান্য সমস্যা হলেও তার প্রভাব গোটা শরীরে পড়ে। অথচ আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন, কাজের ধরন ও ভুল ভঙ্গি মেরুদণ্ডের ওপর অজান্তেই প্রচুর চাপ সৃষ্টি করছে।

সাধারণ মেরুদণ্ডজনিত রোগ

কোমর ব্যথা (Low Back Pain) :
অফিসে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা, ভারী বস্তু তোলা বা ভুল ভঙ্গির কারণে সৃষ্ট সবচেয়ে সাধারণ সমস্যা। এটি অনেক সময় স্নায়ুচাপে রূপ নিয়ে পা পর্যন্ত ব্যথা ছড়িয়ে দিতে পারে।

ঘাড় ব্যথা (Neck Pain) :
মোবাইল ও কম্পিউটারের অতিরিক্ত ব্যবহার এখন ‘টেক্সট নেক সিন্ড্রোম’ নামে নতুন বিপদ ডেকে এনেছে।

স্লিপ ডিস্ক বা প্রোলাপসড ডিস্ক (PLID) :
মেরুদণ্ডের হাড়গুলোর মাঝের নরম ডিস্ক স্থানচ্যুত হয়ে স্নায়ু চেপে ধরে— এতে হাত-পায়ে ব্যথা, ঝিনঝিনি বা দুর্বলতা দেখা দেয়।

মেরুদণ্ডের যক্ষা (Spinal Tuberculosis) :
এখনো বাংলাদেশের গ্রামীণ ও নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ রোগ বিদ্যমান। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে এটি পক্ষাঘাতে পরিণত হতে পারে।

হাড় ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস :
বিশেষ করে বয়স্ক ও মেনোপজ-পরবর্তী নারীদের মধ্যে দেখা যায়। এটি মেরুদণ্ডের ভাঙন বা আকৃতি পরিবর্তনের কারণ হতে পারে।

স্পাইনাল ইনজুরি (Spinal Injury) :
সড়ক দুর্ঘটনা, পড়ে যাওয়া বা খেলাধুলায় আঘাতের ফলে মেরুদণ্ড ভেঙে গেলে তা স্থায়ী পক্ষাঘাত ডেকে আনতে পারে।

মেরুদণ্ড বা স্পাইন আমাদের দেহের ‘অক্ষ’– একে বলা যেতে পারে জীবনের ভিত্তি। প্রত্যেক মানুষের সচেতনতা ও সেবার সুযোগ না থাকলে যে পরিমাণ শারীরিক ও অর্থনৈতিক ব্যয় হতে পারে, তা অবহেলা করলে চলবে না। 

আবার, মেরুদণ্ড-চোট (spinal cord injury, SCI) নিয়ে সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় ২০১৮-২০২২ সাল পর্যন্ত ৩,০৩৫ জন রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে; তাদের গড় বয়স ছিল ৩৮.৩ বছর, পুরুষ প্রায় ২.৫ গুণ বেশি, ৫৯.৬ শতাংশ ছিল ট্রমাজনিত এবং ৪০.৪ শতাংশ রোগজ‐কারণ (যেমন— টিউমার, সংক্রমণ) ।

এছাড়াও, স্পাইন সমস্যার প্রভাব শুধু ব্যক্তি স্বাস্থ্যেই সীমাবদ্ধ না; কর্মদক্ষতা, পারিবারিক আয়, সামাজিক জীবন সবকিছুকে ছেদ দেয়— কর্মক্ষম জনসংখ্যা প্রভাবিত হয়। একটি আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নতুন SCI রোগীর সংখ্যা বছরে ৩,২৮০-৬,৫৬০ জন হতে পারে।

এ ধরনের বিশাল চাহিদার মোকাবিলায় আমাদের চিকিৎসা অবকাঠামো ও মানবসম্পদ এখনই শক্তিশালী করতে হবে।

প্রতিরোধই সর্বোত্তম চিকিৎসা
•    সঠিক ভঙ্গিতে বসুন ও দাঁড়ান।
•    দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে মাঝেমধ্যে উঠে হাঁটুন।
•    ভারী বস্তু তোলার সময় কোমর বাঁকাবেন না, হাঁটু ভাঁজ করে তুলুন।
•    নিয়মিত ব্যায়াম ও কোর পেশি শক্ত রাখার অনুশীলন করুন।
•    ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন

বাংলাদেশে স্পাইন সার্জারির যাত্রা :
বাংলাদেশে স্পাইন সার্জারির পথিকৃৎ প্রফেসর এসএম ইদ্রিস আলী। তার হাত ধরেই এই সাবস্পেশালিটি প্রতিষ্ঠার শুরু। পরে প্রফেসর ডা. মো. শাহ আলম আধুনিক পদ্ধতি ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন চিকিৎসা দেশের মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসেন। তার উদ্যোগে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ স্পাইন অ্যান্ড অর্থোপেডিক হাসপাতাল(BSOH), যা দেশের বেসরকারি পর্যায়ে স্পাইন সার্জারির মানোন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।

সরকারি পর্যায়ে বর্তমানে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (NITOR) বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে পূর্ণাঙ্গ স্পাইন ইউনিট চালু আছে। ঢাকা মেডিকেলের স্পাইন ইউনিটের প্রধান ডা. শহিদুল ইসলাম আকন। এছাড়া সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজসহ কয়েকটি প্রান্তিক মেডিকেলে সীমিত পরিসরে অপারেশন ও চিকিৎসাসেবা চলছে।

তবুও বাস্তবতা হলো— পুরো দেশে সরকারি পর্যায়ে মাত্র একজন সহযোগী অধ্যাপক ও ১৭ জন সহকারী অধ্যাপক স্পাইন সার্জারিতে নিয়োজিত আছেন।

১৭ কোটি জনসংখ্যার জন্য এই সংখ্যা একেবারেই অপর্যাপ্ত। 

বর্তমান বাস্তবতা
বাংলাদেশে এখনো স্পাইন সার্জন বা মেরুদণ্ড বিশেষজ্ঞের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। অনেক জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে এমনকি মেডিকেল কলেজেও বিশেষায়িত স্পাইন ইউনিট নেই। ফলে রোগীরা প্রাথমিক চিকিৎসার অভাবে জটিল অবস্থায় ঢাকাসহ বড় শহরে ছুটে আসেন।
অন্যদিকে, অনেক রোগী উন্নত চিকিৎসার আশায় ভারত, সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডে যান, এতে করে দেশ থেকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই এই রোগগুলোর সফল চিকিৎসা বাংলাদেশেই সম্ভব, যদি পর্যাপ্ত অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা থাকে।

সংকীর্ণতার মূল কারণ
১. প্রশিক্ষিত জনবল ও বিশেষজ্ঞের অভাব
    এখনো অধিকাংশ চিকিৎসক সাধারণ অর্থোপেডিক সার্জন হিসেবে কাজ করেন; বিশেষায়িত স্পাইন সার্জন সংখ্যা খুবই সীমিত।
২. আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ইমেজিং সুবিধার ঘাটতি
    জেলা হাসপাতালগুলোতে (CT Scan, MRI) বা মাইক্রোস্কোপিক সার্জারির সুযোগ অপ্রতুল।
৩.পুনর্বাসন ও ফিজিওথেরাপি সেবার অভাব
    অপারেশনের পর রোগীর ফলোআপ ও পুনর্বাসনের যথাযথ ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে।
৪. গবেষণা ও তথ্যভিত্তিক নীতি প্রণয়নের ঘাটতি
    স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত ডেটার অভাবে রোগের প্রকৃতি ও চিকিৎসার ফলাফল নির্ভর নীতিমালা তৈরি হয় না।

সুপারিশ ও আহ্বান
স্পাইন সার্জারির সেবার সুযোগ ১৭ কোটি মানুষের জন্য কার্যকারণভাবে সমানভাবে নিশ্চিত করতে হলে, সরকারের নীতি ও পদক্ষেপ দ্রুত এবং দৃঢ় হতে হবে। নিম্নলিখিত প্রস্তাবনা বিবেচনা করা যেতে পারে—

মানবসম্পদ বৃদ্ধি ও বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ : সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপকদের সংখ্যা বাড়িয়ে বেশি প্রশিক্ষিত স্পাইন সার্জন তৈরি করতে হবে।
স্পাইন ইউনিট প্রতিষ্ঠা
    প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি করে বিশেষায়িত স্পাইন ইউনিট গঠন করা জরুরি। এতে প্রশিক্ষণ, সার্জারি ও গবেষণা তিনটিই সম্ভব হবে।
স্পাইন সার্জন তৈরিতে বিনিয়োগ
    স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ফেলোশিপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে তরুণ চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
সরকার-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ
    জেলা পর্যায়ে মাইক্রোস্কোপিক সার্জারি, এন্ডোস্কোপিক সুবিধা ও ইমেজিং ব্যবস্থার উন্নয়ন অপরিহার্য।

নিয়মিত রোগদর্শন ও অপারেশন সেবা প্রাণবন্ত রাখা : প্রান্তিক হাসপাতালগুলোতে (জেলা, Divisional মেডিকেল কলেজ) নিয়মিত স্পাইন অপারেশন ও রোগপরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে।

ন্যাশনাল স্পাইন রেজিস্ট্রি ও তথ্যভাণ্ডার গঠন : রোগের প্রকৃতি, ফলাফল, জটিলতা ও ফলাফল বিশ্লেষণের জন্য ডেটা সংগ্রহ জরুরি।

জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রিভেনশন : ভালো ভরসামূলক কান্ডাকশন, ঠিকভাবে বসা-চলাচল, মজুত ও স্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা।

গবেষণা ও উদ্ভাবন উৎসাহিত করা : স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে স্পাইন প্রযুক্তি, ইমপ্লান্ট ও যত্ন উন্নয়নের জন্য অনুদান ও গবেষণার সুযোগ দেওয়া।

বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষার সুযোগ

বাংলাদেশের বিপুল রোগী প্রতি বছর মেরুদণ্ডের অপারেশন ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন— বিশেষ করে ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়। এর ফলে প্রতি বছর দেশের কোটি কোটি টাকা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি দেশেই উন্নত অবকাঠামো, দক্ষ সার্জন এবং আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর স্পাইন সেবা গড়ে তুলতে পারি, তাহলে সেই অর্থ দেশের মধ্যেই থেকে যাবে। বরং প্রতিবেশী দেশগুলোর রোগীও বাংলাদেশে এসে চিকিৎসা নিতে পারেন— এতে চিকিৎসা-ভিত্তিক বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব হবে।

সরকার, সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ, মেডিকেল কলেজ, চিকিৎসক সমাজ ও জনসাধারণ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। স্পাইন সার্জনদের প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো বিনিয়োগ ও পরিকল্পিত নীতিমালার মাধ্যমে দ্রুতগতিতে এই অপ্রতুলতা মোকাবিলা করতে হবে। ১৭ কোটি মানুষের মেরুদণ্ড সুস্থ রাখতে এই উদ্যোগ এখনই নেওয়া উচিত।

ভবিষ্যতের আশা
বাংলাদেশে এখন কিছু তরুণ ও দক্ষ স্পাইন সার্জন নিজেদের প্রচেষ্টায় দেশীয়ভাবে জটিল সার্জারি সফলভাবে সম্পন্ন করছেন। এটি আশার আলো। যদি সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো একসঙ্গে কাজ করে, তবে খুব শিগগিরই বাংলাদেশেই বিশ্বমানের স্পাইন কেয়ার সেন্টার গড়ে তোলা সম্ভব।

জনসচেতনতা ও প্রতিরোধ
স্কুল, অফিস ও কারখানায় সঠিক ভঙ্গিমা এবং পিঠের যত্ন নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা প্রয়োজন।
স্পাইন স্বাস্থ্যসেবা শুধু কয়েক জন রোগীর জন্য নয়; এটি একটি বৃহত্তর জনস্বাস্থ্য ইস্যু। আজ, বিশ্ব স্পাইন ডে-তে, আমাদের মনে রাখতে হবে— যে মানুষগুলো হাঁটতে পারে, বসতে পারে, কাজ করতে পারে, তারা হয়তো কোনো সময় ব্যথা, বিকৃতি বা দুর্ঘটনার কারণে সর্বনাশের মুখে পৌঁছাতে পারে। আমাদের কর্তব্য হলো, সঠিক সময়ে সঠিক সেবা পৌঁছে দেওয়া এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকা।

সোজা হয়ে দাঁড়ানো মানে আত্মবিশ্বাস, আর সক্রিয় থাকা মানে সুস্থ জীবন। নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক ভঙ্গি, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং সচেতনতা এই চারটি বিষয়ই মেরুদণ্ডকে রাখবে সুস্থ ও শক্তিশালী। মেরুদণ্ডের যত্ন মানেই জাতির শক্তির যত্ন। সরকার, চিকিৎসক সমাজ ও সাধারণ জনগণ যদি একসঙ্গে সচেতন হয়, তবে বাংলাদেশেই গড়ে উঠবে আধুনিক স্পাইন চিকিৎসার পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা। এটি শুধু জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নই নয়, বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণেও ভূমিকা রাখবে।

সোজা হয়ে দাঁড়ান, সক্রিয় থাকুন, সচেতন থাকুন। আপনার মেরুদণ্ড আপনার শক্তি। মেরুদণ্ডের যত্নে সচেতন হই।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক (স্পাইন সার্জারি), খুলনা মেডিকেল কলেজ, খুলনা

Read Entire Article