বিশ্ব রাজনীতির ভবিষ্যত কোন পথে?

12 hours ago 4

সাম্প্রতিক সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনে এক বিরল দৃশ্যের সাক্ষী হলো বিশ্ব। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং—এই তিন শক্তিধর নেতাকে একই মঞ্চে বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপচারিতায় দেখা গেল। যা বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে প্রতীকী মুহূর্তের গুরুত্ব অপরিসীম। তাইতো মাত্র কয়েক মিনিটের সেই দৃশ্য বিশ্ব রাজনীতিকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। প্রশ্ন উঠেছে—চীনের নেতৃত্বে কি এক নতুন অক্ষ তৈরি হচ্ছে? যদি হয়, তবে তা কতটা স্থায়ী হবে এবং বিশ্বের শক্তি-বিন্যাসে এর প্রভাব কতদূর বিস্তৃত হবে?

এসসিও এবং বহু মেরু বিশ্বের পুনরুজ্জীবন

‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’ (এসসিও) দীর্ঘদিন ধরেই আঞ্চলিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তার জন্য একটি বড় প্ল্যাটফর্ম। তবে এবারের সম্মেলনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ভারত-চীন-রাশিয়ার সম্ভাব্য অক্ষ। এক মেরু বিশ্বব্যবস্থার ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু অবস্থান, এই নতুন সম্ভাবনা বহু মেরু বিশ্বের উত্থানকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। শি জিনপিংয়ের কূটনৈতিক বার্তা ছিল স্পষ্ট—চীন আর কেবল আঞ্চলিক শক্তি নয়, বরং বিশ্ব নেতৃত্বের দাবিদার। তার বক্তব্যে “জঙ্গলরাজে ফিরে যাওয়া” নিয়ে যে সতর্কবার্তা শোনা গেল, তা মূলত আমেরিকার প্রতি পরোক্ষ বার্তা হিসেবেই ধরা হচ্ছে।

ট্রাম্পের নীতি ও অক্ষ গঠনের প্রেক্ষাপট

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। ভারতের উপর অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়ে তিনি যে সংকট তৈরি করেছেন, তা শুধু দিল্লির নয়, গোটা এশিয়ার অর্থনীতিকেই প্রভাবিত করছে। ভারতীয় রপ্তানি বাজারে এই শুল্কের প্রভাব পড়েছে সরাসরি। এর প্রভাবে তাদের  লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়ছে। এ অবস্থায় মোদির সামনে কূটনৈতিক বিকল্প খোঁজা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। পুতিন ও শির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা মূলত ট্রাম্পের চাপেরই প্রতিক্রিয়া।

মোদি, পুতিন ও শি: ত্রয়ীর কূটনৈতিক দোলাচল

কূটনীতিতে শরীরী ভাষার তাৎপর্য অপরিসীম। তাই যখন ক্যামেরায় ধরা পড়ল তিন নেতার হাসি-ঠাট্টার দৃশ্য, তখনই বিশ্বব্যাপী আলোচনার ঝড় উঠল। কিন্তু এই সাময়িক বন্ধুত্ব কতটা টেকসই? ভারত ও চীনের সীমান্তবিরোধ, গালওয়ানের রক্তাক্ত ইতিহাস, অরুণাচল-আসামের নদী-সংকট—এসব ইস্যু এখনো অমীমাংসিত। অন্যদিকে, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি সামরিক সম্পর্ক থাকলেও, ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে মস্কো আরও বেশি চীনের দিকে ঝুঁকেছে। ফলে এই ত্রয়ীর সম্পর্ককে অনেকেই “অস্বস্তিকর বাস্তবতা” বলেই অভিহিত করছেন।

এসসিও সম্মেলনে ধরা পড়া কয়েক মিনিটের ছবি হয়তো ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব পাবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—এটি কি এক নতুন বিশ্ব অক্ষের জন্ম, নাকি কেবল প্রতীকী বন্ধুত্ব? চীন-ভারতের সীমান্তবিরোধ, রাশিয়ার পশ্চিমা চাপ, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমীকরণ—সব মিলিয়ে এই অক্ষ টেকসই হওয়ার সম্ভাবনা সীমিত। তবে এটুকু স্পষ্ট যে, এক মেরু বিশ্বব্যবস্থার দিন শেষের পথে, আর বহু মেরু বিশ্ব বাস্তবিক হয়ে উঠছে। চীনের নেতৃত্বে যদি সত্যিই এক নতুন অক্ষ গঠিত হয়, তবে তা শুধু মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করবে না, বরং ছোট-বড় সব রাষ্ট্রকেই নতুন করে তাদের কূটনৈতিক অবস্থান পুনর্নির্ধারণে বাধ্য করবে।

পাকিস্তান ও তুরস্ক ফ্যাক্টর

এসসিওর মঞ্চে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকেও দেখা গেছে। মোদির সঙ্গে এরদোয়ানের উষ্ণ করমর্দন ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষত যখন পাকিস্তানকে ড্রোন সরবরাহের অভিযোগে এরদোয়ান সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পাকিস্তান-চীন-তুরস্কের অঘোষিত ঘনিষ্ঠতা ভারতীয় কূটনীতিকে জটিল করছে। এসসিওর মঞ্চে এই সব প্রতিপক্ষের সঙ্গেই একইসাথে সম্পর্ক রক্ষা করা ভারতের জন্য নিঃসন্দেহে কঠিন চ্যালেঞ্জ।

শি জিনপিংয়ের উচ্চাভিলাষী বার্তা

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং একাধিকবার বলেছেন, চীন বিশ্ব নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিরুদ্ধে চীনের লড়াইয়ের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত কুচকাওয়াজে তার বক্তৃতা ছিল স্পষ্টতই মার্কিনবিরোধী। তার বার্তা—চীন শক্তিশালী, অপ্রতিরোধ্য এবং বহিরাগত চাপের কাছে কখনো নতি স্বীকার করবে না। এই বক্তব্য শুধু দেশীয় জনগণের জন্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করেই দেওয়া। বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে এটি এক ধরনের ঘোষণা। যা নিঃসন্দেহে নতুন এক মেরুকরণের ইঙ্গিত ও বটে।

রাশিয়ার ভূমিকা ও পুতিনের কৌশল

পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই ভারত-চীন-রাশিয়া অক্ষ গঠনে উৎসাহী। ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা চাপের মুখে রাশিয়ার কৌশলগত প্রয়োজন আরও বেড়েছে। মস্কোর জন্য ভারত ও চীনকে একই মঞ্চে আনা একাধারে কূটনৈতিক সাফল্য এবং অর্থনৈতিক বেঁচে থাকার কৌশল। তবে প্রশ্ন হলো—রাশিয়ার এ প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে? চীন-ভারতের সীমান্তবিরোধ এবং ভারতের পশ্চিমা জোটের সঙ্গে বাণিজ্যিক স্বার্থ এই অক্ষকে কতটা টেকসই করবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া

ওয়াশিংটন থেকে ইতোমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ট্রাম্প সরাসরি অভিযোগ করেছেন—চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া মিলে আমেরিকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই ভাষ্য কেবল মার্কিন জনমতকেই প্রভাবিত করছে না, বরং বৈশ্বিক মিত্ররাষ্ট্রগুলোকেও সতর্ক করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো মিত্ররা এই সম্ভাব্য অক্ষের দিকে কড়া নজর রাখছে। কারণ, এশিয়া যদি সত্যিই নতুন শক্তির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, তবে তা পশ্চিমা আধিপত্যকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করবে।

বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় দিক

এই বৈশ্বিক পালাবদল বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ একইসাথে চীনের অবকাঠামোগত বিনিয়োগ, ভারতের আঞ্চলিক প্রভাব এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলছে। বহু মেরু বিশ্বের উদ্ভব হলে বাংলাদেশের কূটনীতিকে আরও সূক্ষ্ম ও বিচক্ষণ হতে হবে। বিশেষত, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, কোয়াড এবং এসসিও—সব কিছুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করলেও, অতি-ঝুঁকি এড়ানোই হবে বাস্তবমুখী নীতি।

এসসিও সম্মেলনে ধরা পড়া কয়েক মিনিটের ছবি হয়তো ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব পাবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—এটি কি এক নতুন বিশ্ব অক্ষের জন্ম, নাকি কেবল প্রতীকী বন্ধুত্ব? চীন-ভারতের সীমান্তবিরোধ, রাশিয়ার পশ্চিমা চাপ, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমীকরণ—সব মিলিয়ে এই অক্ষ টেকসই হওয়ার সম্ভাবনা সীমিত। তবে এটুকু স্পষ্ট যে, এক মেরু বিশ্বব্যবস্থার দিন শেষের পথে, আর বহু মেরু বিশ্ব বাস্তবিক হয়ে উঠছে। চীনের নেতৃত্বে যদি সত্যিই এক নতুন অক্ষ গঠিত হয়, তবে তা শুধু মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করবে না, বরং ছোট-বড় সব রাষ্ট্রকেই নতুন করে তাদের কূটনৈতিক অবস্থান পুনর্নির্ধারণে বাধ্য করবে। আর এখানেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যৎ বিশ্ব রাজনীতির আসল নাটকীয়তা।

লেখক : গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

[email protected]

এইচআর/জিকেএস

Read Entire Article