স্বাধীনতার পরে প্রায় দেড়শ পাট ও বস্ত্রকল জাতীয়করণ করেছিল তৎকালীন সরকার। দেশের পাট, সুতা ও বস্ত্রের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করতো এসব কল-কারখানা। পরবর্তীসময়ে বেসরকারিখাতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, যুগোপযোগী নতুন বাজার তৈরি করতে না পারার কারণে রুগণ হতে হতে একসময় বন্ধ হয়ে যায়।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এসব বস্ত্র ও পাটকল বেসরকারিখাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঢিলেঢালাভাবে কিছু ইজারা দেওয়া সম্ভবও হয়। অন্তর্বর্তী সরকার বাকিগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে ইজারা দিতে চায়।
নানা চড়াই-উৎরাইয়ে দেশে পাট ও বস্ত্র কারখানার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে পঞ্চাশে। এর মধ্যে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) ২৫টি পাটকল ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের (বিটিএমসি) হাতে রয়েছে ২৫টি বস্ত্রকল। অধিকাংশ বন্ধ ওইসব কল-কারখানার মধ্যে দুই প্রতিষ্ঠান মিলে ৩৬টি কারখানা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) অথবা ইজারায় চালাতে চেয়েছিল সরকার। বস্ত্রকল ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল বিগত সরকারের সময় প্রায় এক দশক আগে, আর পাটকল পাঁচ বছর আগে ২০২০ সালে।
ইজারা হয়েছে ২০টি, বাকি ১৬টি
পাঁচ বছরে বিজেএমসির পাঁচটি মিল বাদে ইজারাযোগ্য ২০টি পাটকলের ১৩টি ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। পড়ে আছে সাতটি।
আর এক দশক আগে থেকে বিটিএমসির অধীনে মোট ২৫টি বস্ত্রকলের মধ্যে ১৬টি পিপিপি অথবা ইজারায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও এ পর্যন্ত মাত্র সাতটি বেসরকারি খাতে দেওয়া গেছে। অর্থাৎ, তাদেরও ৯টি মিল এখনো ইজারাযোগ্য রয়েছে। ফলে দুই সংস্থা মিলে মোট ১৬টি রাষ্ট্রীয় কারখানা এখন বেসরকারিখাতে ইজারা দেওয়ার পথে হাঁটছে কর্তৃপক্ষ।
বাকিগুলো দ্রুত ইজারা দিতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার
বিগত সরকারের সময় ইজারা কার্যক্রম ঢিলেঢালা হলেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত বন্ধ পাট ও বস্ত্রকলগুলো উদ্যোক্তাদের হাতে ছেড়ে দিতে চায়। নানা বৈঠক-অনুষ্ঠানে সরকারের বন্ধ পাট ও বস্ত্রকলে বিনিয়োগের জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
পাকিস্তান, চীনসহ বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীদেরও এসব পাট ও বস্ত্রকলে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হচ্ছে। বিনিয়োগ আনতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সংক্ষিপ্ত বিনিয়োগ প্রস্তাবও দিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে পাট ও বস্ত্রকলে বিনিয়োগের জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেন, ‘এখন সরকার কোনো রাজনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। সরকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আপনাদের যোগ্যতা ও প্রস্তাবের ভিত্তিতে। দয়া করে অসম্ভব সুন্দর এসব বন্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করুন, নিজে লাভবান হন, দেশকে লাভবান করুন। দেশের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করুন।’
আরও পড়ুন
- ২২ বছর বন্ধ থাকার পর প্রাণ ফিরেছে রাজশাহী টেক্সটাইল মিলে
- বন্ধ পাটকলগুলোর ১০৫৬ শ্রমিকের পাওনা পরিশোধে দেরি হচ্ছে
- বন্ধ পাটের মিলে বেসরকারি বিনিয়োগের আহ্বান
এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুর রউফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা প্রতিটি মিল লিজ দেওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করছি। তবে একটি মিল নেওয়া, তাতে সঠিক ও যুগোপযোগী বিনিয়োগ করা বেসরকারিখাতের জন্যও সময়সাপেক্ষ বিষয়। যে কারণে আগে সাড়া কম পেয়েছি। তবে এটি চলমান প্রক্রিয়া। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ এখন বাড়ছে। সম্প্রতি বেশ কিছু মিল বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
বিজেএমসির সাতটি মিল ইজারা প্রক্রিয়াধীন
বিজেএমসির মোট ২৫টি পাটকলের উৎপাদন কার্যক্রম ২০২০ সালের ১ জুলাই সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর কো-অপারেটিভ জুট মিল পুনঃগ্রহণ করে সংস্থাটির মিলের সংখ্যা হয় ২৬টি। এর মধ্যে আবার জুটো ফাইবার গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি কারখানায় ঢাকাই মসলিন হাউজ স্থাপন করতে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সবশেষ নিয়ন্ত্রণে থাকা ২৫টি মিলের মধ্যে আইনগত জটিলতায় বাগদাদ-ঢাকা কার্পেট ফ্যাক্টরি ও আলীম জুট মিল এবং জমির অবস্থান ও বাণিজ্যিক বিবেচনায় অন্য মিলগুলো থেকে ভিন্নতর হওয়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিনটি মিল (করিম জুট মিল, লতিফ বাওয়ানী জুট মিল ও আমিন জুট মিল) ইজারা দেওয়া হয়নি। ইজারার জন্য নির্বাচিত বাকি ২০টি মিলের মধ্যে এখন ১৩টির ইজারা সম্পন্ন হয়েছে।
আমরা প্রতিটি মিল লিজ দেওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করছি। তবে একটি মিল নেওয়া, তাতে সঠিক ও যুগোপযোগী বিনিয়োগ করা বেসরকারিখাতের জন্যও সময়সাপেক্ষ বিষয়। যে কারণে আগে সাড়া কম পেয়েছি। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ এখন বাড়ছে।- বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুর রউফ
ইজারা দেওয়া মিলগুলো হলো- বাংলাদেশ জুট মিল, যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ, দৌলতপুর জুট মিল, কার্পেটিং জুট মিল, মিলস ফারনিশিংস, গালফ্রা হাবিব, গুল আহমদ জুট মিল, ইউএমসি জুট মিল, খালিশপুর জুট মিল, ইস্টার্ন জুট মিল, আর আর জুট মিল, হাফিজ জুট মিল ও দ্য ক্রিসেন্ট জুট মিলস।
খুলনার প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিল, সিরাজগঞ্জের জাতীয় জুট মিল ও রাজশাহী জুট মিল নবম দফায় ইজারা দেওয়ার জন্য প্রস্তাব সরকারের নীতিমালার আলোকে পরীক্ষা-বিবেচনার জন্য গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় ওয়ার্কিং কমিটিতে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া দশম দফায় আরও তিনটি মিল ইজারার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল। ওই মিলগুলোর বিপরীতে চূড়ান্ত প্রস্তাব পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। মিলগুলো হলো- চট্টগ্রামের কেএফডি লিমিটেড, এম এম জুট মিল ও খুলনার স্টার জুট মিল। বাকি কো-অপারেটিভ জুট মিল ইজারার জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে শিগগির।
বিটিএমসির আছে ৯ মিল
বিটিএমসির অধীনে ২৫টি বস্ত্রকল রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমে ১৬টি পিপিপিতে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি। যদিও পরে পিপিপির পাশাপাশি ইজারা দেওয়ার পথেও হাঁটে তারা। বিগত দশ বছরে এখন পর্যন্ত সাতটি মিল বেসরকারি খাতে দিতে পেরেছে সংস্থাটি।
তবে বিগত সরকারের চেয়ে বর্তমান সরকারের সময় সংস্থাটির মিল ইজারা প্রক্রিয়ায় গতি এসেছে। শেষ এক বছরে তিনটি মিল ইজারা দিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিলস ও চট্টগ্রামের ভালিকা উলেন মিলস এবং সিলেট টেক্সটাইল ইজারা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঢাকার আহমেদ বাওয়ানী টেক্সটাইল, গাজীপুরের কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলস, রাজশাহী টেক্সটাইল মিলস ও চট্টগ্রামের আর আর টেক্সটাইল মিলস পিপিপিতে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আগে।
পাশাপাশি ফেনীর দোস্ত টেক্সটাইল ও খুলনা টেক্সটাইল—এ দুটি মিল ইজারার বিষয়টি চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায় আছে বলে বিটিএমসি সূত্রে জানা যায়। আগ্রহী বিনিয়োগকারী পেলে অন্য মিলগুলোও ইজারা দেওয়া হবে।
বিটিএমসির আরও যেসব ইজারাযোগ্য মিল রয়েছে সেগুলো হলো- বেঙ্গল টেক্সটাইল মিল, সুন্দরবন টেক্সটাইল মিল, দারোয়ানী টেক্সটাইল মিল, আমিন টেক্সটাইল মিল, রাঙ্গামাটি টেক্সটাইল মিল, মাগুরা টেক্সটাইল মিল, টাঙ্গাইল কটন মিল, দোস্ত টেক্সটাইল মিল ও দিনাজপুর টেক্সটাইল মিল।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুর রউফ বলেন, ‘বিটিএমসির ইজারা দেওয়ার কার্যক্রম আগে বিলম্বিত ছিল। এখন কিন্তু গতি পেয়েছে। আবার অনেকে মিল নিয়েছে কিন্তু দ্রুত বিনিয়োগ করতে পারছে না। তবে সবগুলো মিল বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে।’
এনএইচ/এএসএ/এমএফএ/এমএস