বড় হচ্ছে চকলেটের বাজার, কমছে আমদানিনির্ভরতা

2 hours ago 7

দেশে এক দশক আগেও চকলেটের চাহিদার সিংহভাগ আমদানি হতো। এখন এ ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে দেশের বড় বড় শিল্পগ্রুপ। পাল্টে গেছে চিত্র। অভ্যন্তরীণ বাজারের বেশিরভাগ এখন দেশি উৎপাদকদের হাতে। বিশেষ করে সুগার কনফেকশনারি ক্যান্ডি বা লজেন্সের বাজার। পাশাপাশি দামি চকলেটেও হিস্যা ক্রমাগত বাড়াচ্ছে কোম্পানিগুলো।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে চকলেট ও ক্যান্ডির বাজার প্রায় দুই হাজার ৮শ কোটি টাকার। এর মধ্যে ক্যান্ডি বিক্রি হয় প্রায় অর্ধেক। বাকিটা চকলেট ও ওয়েফারজাতীয় পণ্য। প্রতি বছর এই বাজার ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। মূলত মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ নানাবিধ কারণে বড় হচ্ছে চকলেটের বাজার।

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশি চকলেট। প্রতি বছর রপ্তানির সম্ভাবনাও বাড়ছে। কয়েক বছরের মধ্যে এ রপ্তানির পরিমাণ প্রায় হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে বলে আশা উৎপাদকদের।

বড় হচ্ছে চকলেটের বাজার, কমছে আমদানিনির্ভরতা

ক্যান্ডির বাজার দেশি কোম্পানিগুলোর দখলে

দেশে চকলেট বলতে এক সময় ক্যান্ডি বা লজেন্সই চিনতো বেশিরভাগ মানুষ। এসব পণ্যের জনপ্রিয়তাও বহু আগে থেকে। এর সঙ্গে গত এক দশকে ওয়েফার, চুইংগামের চাহিদাও বাড়ছে। সবমিলিয়ে এসব সুগার কনফেকশনারি পণ্যের ৮০ শতাংশের দখল দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে।

এখন বেশ কয়েকটি বড় শিল্পগোষ্ঠী এসব পণ্য তৈরি করছে। এদের মধ্যে প্রাণ-আরএফএল, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, পারটেক্স স্টার গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও আবুল খায়ের গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া এককভাবে চকলেট উৎপাদনকারী অনেক দেশি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা বাজারে ভালো করছে।

দেশে-বিদেশে চকলেটের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। সম্ভাবনা অনেক। দেশের চাহিদার পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন প্রাণের চকলেট রপ্তানি হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী ভারতসহ এশিয়ার বেশ কিছু দেশ, অস্ট্রেলিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনে বাংলাদেশি চকলেটের প্রচুর চাহিদা রয়েছে।- প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল

দেশে ক্যান্ডি ও চকলেট পণ্যের শীর্ষ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি বাজারে মোট চাহিদার প্রায় অর্ধেক পূরণ করছে। দেশে ১৯৯৯ সাল থেকে ক্যান্ডি ও চকলেট বাজারজাত করছে প্রাণ। বছরে প্রবৃদ্ধি শতকরা প্রায় ২০ শতাংশ।

বড় হচ্ছে চকলেটের বাজার, কমছে আমদানিনির্ভরতা

প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় সব ধরনের চকলেট নিজস্ব কারখানায় অত্যাধুনিক ইউরোপীয় মেশিনে তৈরি করা হচ্ছে। হাতের স্পর্শ ছাড়া কঠোর মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নরসিংদীর তিনটি কারখানা, হবিগঞ্জ ও নাটোরের কারখানায় এসব পণ্য তৈরি হয়। প্রাণের কনফেকশনারি পণ্য খাতে বিনিয়োগ কয়েকশ কোটি টাকা। এসব কারখানায় বছরে ৩৬ হাজার টন কনফেকশনারি পণ্য তৈরির সক্ষমতা রয়েছে।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে-বিদেশে চকলেটের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। সম্ভাবনা অনেক। দেশের চাহিদার পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন প্রাণের চকলেট রপ্তানি হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী ভারতসহ এশিয়ার বেশ কিছু দেশ, অস্ট্রেলিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনে বাংলাদেশি চকলেটের প্রচুর চাহিদা রয়েছে।’

আরও পড়ুন
আসিয়ানভুক্ত দেশে রপ্তানি বাড়াতে করণীয়
রপ্তানির ৭০ শতাংশ আয় ১০ দেশ থেকেই, বাড়ছে ঝুঁকি
ওষুধ হিসেবে খাওয়া হতো চকলেট
প্রতিদিন ১ বিলিয়ন মানুষ চকলেট খায়

প্রাণ রপ্তানি কার্যক্রম শুরু করে ২০১০ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ক্যান্ডি রপ্তানির মাধ্যমে। রপ্তানি বাজারে প্রবৃদ্ধিও প্রায় ২০ শতাংশ। ওইসব দেশ ছাড়াও প্রাণের তৈরি কনফেকশনারি পণ্য ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলে পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৮০টি দেশে এসব পণ্য রপ্তানি করছে প্রাণ।

বড় হচ্ছে চকলেটের বাজার, কমছে আমদানিনির্ভরতা

কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘আসিয়ান ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে কনফেকশনারি পণ্য রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাণের লক্ষ্য এসব অঞ্চলে শিগগির রপ্তানি করা। আগামী দিনে এসব অঞ্চলে পণ্য পাঠানো শুরু করলে রপ্তানি আয় বাড়বে।’

সম্ভাবনা দেখছে অন্য কোম্পানিগুলোও

প্রাণের পরেই দেশের অন্যতম চকলেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ। বছরে প্রায় ১২ হাজার টন ক্যান্ডি উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠানটি। রপ্তানি করছে ৩৫ দেশে। এর মধ্যে অলিম্পিক নজর দিয়েছে উন্নমানের চকলেট উৎপাদনেও।

বাংলাদেশের মানুষের চকলেট খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। তবে এদেশে বিদেশ থেকে আসা চকলেটের একটি বড় অংশই আসছে চোরাইপথে, বিদেশফেরত লোকজনের মাধ্যমে।- নেসলের কোম্পানি সেক্রেটারি দেবব্রত রয় চৌধুরী

চলতি বছরই চকলেট উৎপাদনের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি এবং কারখানা আধুনিক করার ঘোষণা দিয়েছিল কোম্পানিটি। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের লোলাতি কারখানায় নতুন আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করছে অলিম্পিক। ওইসব যন্ত্রের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা তিন হাজার টন।

অলিম্পিক কর্তৃপক্ষ জানায়, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপনের মাধ্যমে উৎপাদন সক্ষমতা আগের চেয়ে বাড়িয়ে বাজারে উচ্চমানের চকলেটপণ্যের চাহিদা পূরণ করতে চায় তারা। এতে চকলেটের ক্রমবর্ধমান বাজারে অলিম্পিকের অবস্থান আরও শক্তিশালী হচ্ছে।

১৯৭৯ সালে যাত্রার শুরুতে কোম্পানিটির নাম ছিল বেঙ্গল কার্বাইড লিমিটেড। ১৯৯৬ সালে নাম বদল করে হয় অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। সেই বছর থেকে বিস্কুট ও কনফেকশনারি ব্যবসায় নাম লেখায় প্রতিষ্ঠানটি। তাতে সাফল্যও আসে কয়েক বছরে। এরপর ব্যবসার পরিধি ক্রমাগত বেড়েছে। যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন পণ্য ও উৎপাদন লাইন।

বড় হচ্ছে চকলেটের বাজার, কমছে আমদানিনির্ভরতা

চকলেটের বাজারে প্রবেশ করেছে আরেক দেশীয় প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপও। তারা ফ্রেশ চকলেট ব্র্যান্ড নামে চকলেট উৎপাদন শুরু করছে।

বহুজাতিক চকলেটের বাজারও বড়

ক্যান্ডি ও লজেন্সে দেশি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে থাকলেও বিদেশি চকলেট বিপণনে এখনো ভালো অবস্থানে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। বিশেষ করে দামি চকলেটের বাজারে বড় অবস্থান রয়েছে নেসলের। আবার দেশীয় কোম্পানির পাশাপাশি ইতালির বহুজাতিক কোম্পানি পারফেটি ভ্যান মেল (পিভিএম) স্থানীয়ভাবে ক্যান্ডি ও চুইংগাম উৎপাদন করছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চকলেট তৈরি হয় কোকো বীজের গুঁড়া বা কোকো পাউডার থেকে। তবে বাংলাদেশে এই পণ্যের বাণিজ্যিক চাষ নেই। এ কারণে দেশে চকলেটপণ্যের বেশির ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করা বহুজাতিক চকলেটের দখলে।

যে কারণে দামি চকলেটের মধ্যে ৭০ শতাংশ বিদেশ থেকে আসা চকলেট, বাকিটা দেশে তৈরি হচ্ছে। তবে বিদেশ থেকে আসা চকলেটের একটি বড় অংশই আসে বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশফেরত লোকজনের মাধ্যমে। ফলে এসব চকলেটের সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই।

বর্তমানে বিদেশি চকলেটের জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে কিটক্যাট, ক্যাডবেরি, মারস, ফাইভ স্টার, বর্নভিল ইত্যাদি। বাজারে নেসলের আমদানি করা কিটক্যাট অনেক বেশি জনপ্রিয়। আবার নেসলের মাঞ্চ চকলেট দেশে তৈরি হচ্ছে।

নেসলে বাংলাদেশ পিএলসির প্রধান কর্মকর্তা (লিগ্যাল, রেগুলেটরি ও করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) এবং কোম্পানি সেক্রেটারি দেবব্রত রয় চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের চকলেট খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। তবে এদেশে বিদেশ থেকে আসা চকলেটের একটি বড় অংশই আসছে চোরাইপথে, বিদেশফেরত লোকজনের মাধ্যমে।’

বড় হচ্ছে চকলেটের বাজার, কমছে আমদানিনির্ভরতা

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যত কিটক্যাট বিক্রি হচ্ছে, উৎপাদক হয়েও নেসলে তার অর্ধেকও বিপণন করতে পারে না। এতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে।’

সংকটও আছে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের

দেশে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চকলেট চোরাইপথে আসার কারণে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান নিম্নমান ও নকল চকলেট সরবরাহ করছে। নিম্নমানের ও নকল চকলেট সাধারণত কোকোর পরিবর্তে সস্তা উদ্ভিজ্জ তেল, কৃত্রিম রং ও স্বাদের জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে। আবার প্রায়ই আসল পণ্যের নকল ও হুবহু প্যাকেজিং ব্যবহার করে বাজারে চকলেট বিক্রি হচ্ছে, যা এ খাতকে হুমকির মুখে ফেলছে।

প্রতিযোগীদের চেয়ে খরচ বেশি দেশি উৎপাদকের

দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর চকলেট রপ্তানির প্রতিযোগী দেশ ভারত, তুরস্ক ও ব্রাজিল। তাদের কাঁচামাল সহজলভ্য হওয়ায় খুব কম খরচে ভালো মানের পণ্য উৎপাদন করছে। এগিয়ে যাচ্ছে রপ্তানি বাজারে।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘চকলেটের প্রধান কাঁচামাল চিনি। এদেশে চিনির দাম অন্য যে কোনো প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বেশি। একই অবস্থা অন্য কাঁচামাল ও জ্বালানির ক্ষেত্রে।’

এছাড়া এর কোকোয়া পাউডার ও প্যাকেজিংয়ের উপকরণগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সেসব ক্ষেত্রে উচ্চ শুল্ক এ পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ায়। দেশ থেকে পণ্য পাঠানোর খরচও বেশি।

সবমিলিয়ে আমরা প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে রপ্তানিতে পিছিয়ে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে রপ্তানিকারকদের চকলেটের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক হ্রাস ও কিছু সুযোগ-সুবিধা দিলে সার্বিক রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। এছাড়া পণ্যে উৎপাদনে যন্ত্রপাতি আমদানিতেও বিশেষ ছাড় দিতে হবে। তাহলে নতুন উদ্যোক্তারা এ খাতে ভালো করবে।

বহুজাতিকের শুল্ক সমস্যা

নেসলের দেবব্রত রয় চৌধুরী বলেন, ‘দামি চকলেটগুলোতে উচ্চশুল্ক নির্ধারণ করা রয়েছে। যে কারণে সেটা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ক্রমক্ষমতার মধ্যে আনা যাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘চকলেট আমদানিতে প্রায় ৭০ শতাংশ শুল্ক-কর রয়েছে। আবার চকলেটের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন মূল্য অনেক সময় বিশ্ববাজারের চেয়ে বেশি ধরা হয়। যে কারণে আমদানিকারকরা অসম প্রতিযোগিতায় পড়েন।’

ফলে অনানুষ্ঠানিক বা শুল্ক-কর ফাঁকি দিয়ে বিপুল পরিমাণ চকলেট দেশে আসে। এতে যেমন প্রকৃত আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমন সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। আর ভোক্তারা স্বল্পমূল্যে ভালো পণ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এনএইচ/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম

Read Entire Article