ভবিষ্যৎ রাজনীতি, সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতি কোন পথে?

4 hours ago 7

গত এক যুগে বাংলাদেশের রাজনীতির পটে ঘটে গেছে নানা পরিবর্তন। ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ, পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্থান এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান—সব কিছুই একে অপরকে  ভিন্নমাত্রিক যোগসূত্রে যুক্ত করেছে। বিশেষ করে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী তারুণ্য এবং শাহবাগের আন্দোলনের দ্বন্দ্ব বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। প্রশ্নটি হলো—দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি, সমৃদ্ধি এবং সম্প্রীতি কোন পথে যাবে?

২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবিতে। যদিও এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যে, খুব শীঘ্রই তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত হয়। শাহবাগের মঞ্চ, বিশেষত ইমরান এইচ সরকার এবং লাকী আক্তারের নেতৃত্বে, বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছে, যা দেশের গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়। এই আন্দোলন ধর্মীয় বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়াতে সমর্থন দিয়েছিল, যার ফলে শাহবাগের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নেতারা একসময় দেশব্যাপী ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেন।

তবে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান এক নতুন আন্দোলনের সূচনা করেছে। দেশের তরুণ সমাজ এখন আর শুধু ন্যায়বিচারের জন্য নয়, বরং দেশকে একটি বৈষম্যহীন, সাম্যপূর্ণ ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই নতুন প্রজন্মের মূল লক্ষ্য হল—শাহবাগের ইতিহাসের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন বাংলাদেশের রচনা করা, যেখানে আর কোনো ফ্যাসিবাদ, বৈষম্য কিংবা জুডিশিয়াল কিলিংয়ের পুনরাবৃত্তি হবে না। 

বর্তমান পরিস্থিতি খুবই জটিল। একদিকে রাজনীতির এক শক্তিশালী অংশের মাধ্যমে শাহবাগের পুরোনো নেতারা আবারো নিজেদের পুনর্বাসন করার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে দেশের তরুণ সমাজ সন্ত্রাস, শোষণ এবং বৈষম্যের উপর চাপ সৃষ্টি করছে তখন বাক স্বাধীনতার সুযোগে বিগত রেজিমের নৈরাজ্যকে সুযোগ করে দিচ্ছে। গত ১১ মার্চে শাহবাগের নেত্রী ও শাহবাগের অগ্নিকন্যা খ্যাত লাকি আক্তারের নেতৃত্বে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা তারই প্রমাণ। এর ফলে প্রশ্ন উঠছে, আসলে কি আবারও কোনো ‘নতুন শাহবাগ’ গড়ে তোলা হচ্ছে?

এটি একটি গভীর এবং অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যেখানে তরুণদের প্রতি প্রতিক্রিয়া চরমে পৌঁছেছে। ফলে ২০২৪ সালে, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশের ছাত্র সমাজ ও তারুণ্য একত্রিত হয়ে বিগত দমনমূলক শাসনের ভিত্তি প্রদানকারী হিসেবে শাহবাগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, ২০১৩ সালের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের জুডিশিয়াল কিলিং এবং শাপলা চত্বরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেছে। 

তবে প্রশ্ন থাকে—এই নতুন আন্দোলনের পথে কতটুকু সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতি থাকবে? জুলাই পরবর্তী তরুণদের দাবি যদি দেশকে সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে পুনর্গঠন করতে হয়, তবে শাহবাগের মত অতীতের সকল ভুল সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ সময়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও পরিবর্তন করতে হয়। যেহেতু নতুন রাজনৈতিক সূচনার এই সময়ে তারুণ্য শাহবাগ ও তাদের পূর্ববর্তী মুভমেন্টকে স্বৈরশাসন ও তাদের দমন-পীড়নের বৈধতা দানকারী হিসেবে চিহ্নিত করছে, তাই শাহবাগের উচিত হবে জুলাই পরবর্তী সময়ে তারুণ্য ও সময়ের আকাঙ্ক্ষার সাথে রাজনৈতিক আন্দোলনকে পুনর্মূল্যায়ন করা। তা না হলে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী তারুণ্য ও নতুন রাজনৈতিক পটভূমিতে তারা একটি কালো চরিত্র হিসেবে অভ্যুদয় হবে। যেমনটা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জামায়াতকে ভুগতে হচ্ছে ঠিক তেমনি শাহবাগকে সেই পরিণতি বরণ করতে হতে পারে। তাই জুলাই পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের এই সময় শাহবাগ ও তরুণদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যেহেতু তারা একদিকে অতীতের কলঙ্কিত ইতিহাস থেকে মুক্তি চায়, অন্যদিকে দেশে একটি নতুন, স্বচ্ছ এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে চায়। 

প্রসঙ্গত ২০২৫ সালের পরবর্তী রাজনৈতিক দৃশ্যপটে যেমনটা দেখা যাচ্ছে তা হলো, তরুণরা যে কোন মূল্যে ‘শাহবাগ’ পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হতে দিবে না, বরং তারা নিজেদের চেতনা অনুযায়ী একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সাম্প্রতিক ১১মার্চের ঘটনা ও শাহবাগের নেতৃত্বের সামনে আসা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও সারাদেশে শিক্ষার্থীদের চরম প্রতিক্রিয়া দুই তারুণ্যকে দূরে ঠেলে দিবে যা দেশ ও জাতির দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতার অন্তরায়।

এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য এক শক্তিশালী সংলাপ এবং মতবিনিময়ের প্রক্রিয়ার প্রয়োজন। তরুণদের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে একটি সেতু স্থাপন করতে হবে, যাতে তারা একসঙ্গে দেশের উন্নয়নের দিকে কাজ করতে পারে। এর পাশাপাশি, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত একে অপরের প্রতি সম্মান এবং মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে কাজ করা। একে অপরের মতামতকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি কার্যকরী এবং গঠনমূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা ও অতীত ভুল রাজনীতি থেকে শিক্ষা নিতে পারলেই  দেশ এক নতুন সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারবে।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি, সমৃদ্ধি এবং সম্প্রীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, তরুণ সমাজের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা, যাতে তারা দেশ পরিচালনায় সত্যিকারের প্রভাব ফেলতে পারে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রথাগত দলগুলোর মধ্যে একটি নতুন ধরনের সংলাপ এবং সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করা, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সাম্প্রতিক সমস্যাগুলির সমাধান করবে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতির সামনে দুটো পথ রয়েছে— একটি হলো সামগ্রিক বিভাজন, সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা, আর অন্যটি হলো ঐক্য, সংলাপ এবং জাতীয় উন্নয়ন। তরুণ সমাজের উচিত, তারা যেন দেশে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য একসঙ্গে কাজ করতে পারে এবং একটি শক্তিশালী, সুদৃঢ় বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা আরো কার্যকরী করতে পারে।

ইখতিয়ার মাহমুদ : সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট; স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়   

Read Entire Article