ভারত থেকে বাংলাভাষী বিতাড়নের পরিণাম

1 hour ago 3

বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতের মাটিতে বসবাস করা বাংলাভাষাভাষী মানুষকে বিদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এতে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কর্মরত বাংলাভাষীরা বিপদে পড়েছেন। তাদের পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তাদের হঠাৎ ধরে এন সীমান্তে জড়ো করে বাংলাদেশে পুশ ইন করা হচ্ছে। বিষয়টি বড়ই উদ্বেগের। এতে শুধু সাধারণ মানুষই উৎকণ্ঠিত নয়, আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত চিন্তাবিদ ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকেও বিতর্কের প্রান্তে টেনে আনা হয়েছে। সম্প্রতি তিনি এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন, আমার জন্ম ঢাকায়, সেই কারণে চাইলে আমাকেও একদিন বাংলাদেশে পাঠানো হতে পারে !

অন্যদিকে ভারত থেকে বাংলাভাষী ও অনুপ্রবেশকারী তাড়ানো হলে, ‘ভারত থেকে সবার আগে হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো উচিত’ বলে মন্তব্য করেন হায়দরাবাদের সংসদ সদস্য ও মিমের প্রধান জনপ্রিয় নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসি । এই দুটি বিশেষ মন্তব্য এখন বিরাট আলোচনার বিষয়। এগুলো মানুষের মনে ব্যাপক কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।

ভারতের সাম্প্রতিক অভিবাসন নীতি ও বাংলাভাষী সম্প্রদায়কে তাড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তীব্র উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাভাষী সম্প্রদায় বহু প্রজন্ম ধরে ভারতের সমাজ, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক জীবনের অংশ হিসেবে অবদান রেখে আসছে। তাদের হঠাৎ বিতাড়ন কেবল মানবিক সংকট নয়, সামাজিক অস্থিরতা ও সাংস্কৃতিক বিভাজনের সম্ভাবনাও বৃদ্ধি করবে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নাগরিকত্ব ও পরিচয়ের প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরেই অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে। আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (NRC) এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) কার্যত বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে নিশানা করেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই মন্তব্য শুধু ব্যক্তিগত আশঙ্কা নয় বরং নাগরিকত্ব সংকটের এক প্রতীকী সতর্কবার্তা। অমর্ত্য সেনের শেকড় বাংলাদেশের মাটিতে। তার পারিবারিক ইতিহাস ও পূর্বসূত্র ঢাকা ও পূর্ববঙ্গের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। সেখান থেকে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, যদি জন্ম বা ভাষাকে একমাত্র মানদণ্ড ধরা হয় তবে ভারতের কোনো নাগরিকই নিরাপদ নয়। আজ বাংলাভাষীদের টার্গেট করা হচ্ছে কাল হয়তো অন্যদেরও একই পরিণতির মুখে পড়তে হবে।

ভারতবর্ষের বহুভাষিক, বহুজাতিক ও বহু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভেতর বাংলা ভাষার স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যজিৎ, অমর্ত্য সেন বাংলার মাটি থেকে উঠে আসা এসব প্রতিভাই ভারতের ভাবমূর্তিকে বিশ্ব দরবারে উচ্চতায় নিয়ে গেছে। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতীয় রাজনীতিতে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী এক অদ্ভুত সংকটে পড়েছে। বিশেষত নাগরিকপঞ্জি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ঘিরে বাংলাভাষী মুসলিমদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে তাড়ানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটেই অমর্ত্য সেনের আশঙ্কা নতুন করে গুরুত্ব পাচ্ছে।

সীমান্তের দুই পাশে লাখো মানুষ একই ভাষায় কথা বলে, একই সংস্কৃতি ভাগাভাগি করে। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে যদি বাংলা ভাষা সন্দেহজনক পরিচয়ে পরিণত হয় তবে তা শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই অশনি সংকেত। ভারতের শক্তি ভাষা বা ধর্মে বিভাজন নয় বরং সকলকে নিয়ে গণতান্ত্রিক বৈচিত্র্য ধরে রাখা। বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে তাড়ানো মানে সেই শক্তিকে নষ্ট করা। রাজনীতির ক্ষণস্থায়ী লাভের জন্য যদি এমন বৈচিত্র্যবিরোধী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে তার মাশুল শুধু বাংলাভাষীরা নয়, গোটা ভারতকেই দিতে হবে।

অমর্ত্য সেন বহুবার বলেন, ভারতের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তার বৈচিত্র্য ধারণ করার ক্ষমতা। ভাষা, সংস্কৃতি বা ধর্মের ভিন্নতা এখানে কোনোদিন নাগরিকত্ব নির্ধারণের মানদণ্ড হতে পারে না। কিন্তু যখনই নির্বাচনী রাজনীতির সুবিধার্থে বাংলাভাষীদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখা যায়, তখনই ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত কেঁপে ওঠে। সেন আশঙ্কা প্রকাশ করেন এভাবে বৈচিত্র্যের প্রতি আঘাত এলে রাষ্ট্রের ঐক্যকেই দুর্বল করবে।

বাংলাভাষীদের তাড়ানোর রাজনীতি আসলে দুই ধরনের সংকট তৈরি করছে। প্রথমত, ভারতের অভ্যন্তরে যারা বহু প্রজন্ম ধরে বাংলায় কথা বলে আসছে, তারা হঠাৎ করেই নিজেদের নাগরিকত্ব নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশকেও বারবার অযাচিতভাবে এই বিতর্কে টেনে আনা হচ্ছে। ফলে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে অস্বস্তি বাড়ছে। সেনের দৃষ্টিতে এই নীতি কেবল মানবিকতাবিরোধী নয়, এটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকেও আত্মঘাতী। কারণ বাংলাভাষী শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে, অথচ তাদের অবৈধ ঘোষণার হুমকি দিলে সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যায়।

ভারতের বহুত্ববাদী ঐতিহ্য এখানে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। যে রাষ্ট্র সংবিধানে ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য মর্যাদা দিয়েছে, সেখানে নাগরিকত্ব নির্ধারণে কেবল ভাষা বা কাগজপত্রকে মানদণ্ড বানানো সেই সংবিধানের আত্মার পরিপন্থি। এনআরসি প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে, বাংলাভাষীদের একটি বড় অংশ যথাযথ কাগজপত্র না থাকায় তালিকার বাইরে থেকে গেছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে পড়েছে লাখো মানুষ।

অমর্ত্য সেনের মন্তব্যের ভেতরে তাই একধরনের মানবিক প্রতিবাদও নিহিত আছে। তিনি আসলে দেখাতে চেয়েছেন, যদি আইন মানবিকতা হারায়, তবে তা সবার জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। একদিন এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যেখানে নাগরিকত্ব নির্ধারণের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি একজন বিশ্বনন্দিত নোবেলজয়ীকেও বিদেশি বানিয়ে দিতে পারে।

হায়দরাবাদের সাংসদ ও মিম প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়েইসি হঠাৎ্ এই একপক্ষীয় নীতির ফলাফল নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ওয়েইসির মন্তব্যে স্পষ্ট হয় যে অভিবাসন ও নাগরিকত্ব সংক্রান্ত যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সংবেদনশীলতা, মানবিক মূল্যবোধ এবং আইনি কাঠামো অগ্রাধিকার পাবে। হঠাৎ পদক্ষেপ দীর্ঘদিন বসবাসকারী সম্প্রদায়ের অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং সামাজিক দ্বন্দ্ব ও অস্থিরতা বৃদ্ধি করতে পারে।

বাংলাভাষী ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের তাড়ানোর প্রস্তাব ও উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে ওয়েইসি বলেন, ভারত থেকে বাংলাভাষী ও অনুপ্রবেশকারী তাড়ানো হলে সবার আগে হাসিনাকে দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। এই মন্তব্য কেবল রাজনৈতিক মন্তব্য নয়, এটি মন্তব্য আমাদের দেশে একবছর আগে ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয় এবং তার সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের পরিবার ও নিকটজনকে কিছুটা হলেও মানবিক ও আত্মিক স্বস্তি এন দিতে পারে।

ভারতে পালিয়ে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী এক বছরেরও অধিককাল সেখানে অবস্থান করে অনলাইনে নানাবিধ বক্তব্য দিয়ে দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশে তার বিচার শুরু হয়েছে। এজন্য শেখ হাসিনাকে দ্রুত ফেরত চায় বাংলাদেশ। কিন্তু ভারত সে ব্যাপারে নির্বিকার। তার পেছনে নানাবিধ ভূ-রাজনৈতিক কৌশল ও কূটনৈতিক মারপ্যাঁচ রয়েছে।

অমর্ত্য সেন ও ওয়েইসির মন্তব্য আমাদের সতর্ক করে দেয় যে সীমান্ত, ভাষা ও নাগরিকত্ব সংক্রান্ত নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে মানবিক সমন্বয় ও ন্যায়সঙ্গত সমাধান অপরিহার্য। ভারত ভূ-রাজনৈতিক কৌশল দেখিয়ে কোন বাংলাদেশি অপরাধীকে লালন করবে আবার শুধু বাংলাভাষাভাষী ও ধর্মীয় কারণে কাউকে সীমান্তের ওপাড়ে ঠেলে দিয়ে বিতাড়িত করবে তা কোনো সভ্যতার পরিচয় বহন করে না।

অমর্ত্য সেনের আশঙ্কা একটি গভীর রাজনৈতিক বোধেরও প্রকাশ। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন বাংলা ভারতের জাতীয় সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালি সংস্কৃতি ছাড়া ভারতের আধুনিক চিন্তা, সাহিত্য, চলচ্চিত্র কিংবা অর্থনীতি কল্পনা করা যায় না। অথচ আজ রাজনৈতিক সুবিধার জন্য বাংলাভাষীদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। সেনের ভাষায়, এটি কেবল অন্যায় নয়, ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ বিপদসংকেতও বটে।

বাংলাদেশে কথা উঠেছে নরেন্দ্র মোদীর এই বাংলাদেশি তাড়ানোর বুলির পেছনে প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? বাস্তব প্রমাণের ভিত্তিতে এদের চিহ্নিত করার কোনো কার্যকর প্রক্রিয়া নেই। বরং দেখা যায়, সাধারণ মুসলিম শ্রমজীবী পরিবারগুলোই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে বিষয়টি পরিণত হচ্ছে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে। অমর্ত্য সেন আশঙ্কা করেন, যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তবে তা ভারতের নিজস্ব বাংলাভাষী মানুষের সামাজিক ঐক্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং গণতান্ত্রিক আদর্শের জন্য বড় বিপদ হয়ে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশের দিক থেকেও বিষয়টি সংবেদনশীল। কারণ সীমান্তের দুই পাশে লাখো মানুষ একই ভাষায় কথা বলে, একই সংস্কৃতি ভাগাভাগি করে। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে যদি বাংলা ভাষা সন্দেহজনক পরিচয়ে পরিণত হয় তবে তা শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই অশনিসংকেত। ভারতের শক্তি ভাষা বা ধর্মে বিভাজন নয় বরং সবাইকে নিয়ে গণতান্ত্রিক বৈচিত্র্য ধরে রাখা। বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে তাড়ানো মানে সেই শক্তিকে নষ্ট করা। রাজনীতির ক্ষণস্থায়ী লাভের জন্য যদি এমন বৈচিত্র্যবিরোধী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে তার মাশুল শুধু বাংলাভাষীরা নয়, গোটা ভারতকেই দিতে হবে।

হায়দরাবাদের সাংসদ ও মিম প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়েইসির মন্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে অভিবাসন ও নাগরিকত্ব সংক্রান্ত যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সংবেদনশীলতা, মানবিক মূল্যবোধ এবং আইনি কাঠামো অগ্রাধিকার পাওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এরূপ পদক্ষেপ উভয় দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব শক্তিশালী করতে পারে। পাশাপাশি সীমান্ত হত্যা বন্ধ এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা নিরসন, সামাজিক দ্বন্দ্ব ও অস্থিরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই ভারত থেকে বাংলাভাষীদের তাড়ানোর আগে এই গুণীজনদের সাম্প্রতিক মন্তব্য দুটোকে হাল্কাভাবে না নিয়ে বিশেষভাবে ভেবে দেখা উচিত।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/এমএফএ/এমএস

Read Entire Article