মদিনায় হিজরতের ঘটনা
ইসলামের ইতিহাসে নবীজির মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত যুগান্তকারী ঘটনা। নবীজির জন্ম মক্কা নগরীতে। মক্কার আলো-বাতাসে এবং মানুষের ভালোবাসায় বেড়ে ওঠেন তিনি। জীবনে কখনো কারও সঙ্গে বিবাদে জড়াননি। ছোট-বড় কোনো পাপ করেননি। মক্কার মানুষরা তাকে বিশ্বাস করে বলত ‘আল-আমিন’। তবে তিনি যখন নবুয়ত লাভ করার পর মানুষকে অন্যায়-অবিচার ও কুফর-শিরক ত্যাগ করে ইসলামের আলোর পথে আসার দাওয়াত দেন, তখনই সবাই তার বিরোধিতা শুরু করে। একপর্যায়ে শুরু হয় তার ওপর নির্যাতনের ধারা। পথে-প্রান্তরে তাকে নিদারুণভাবে আহত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা হতো। এরপরও অত্যন্ত ধৈর্য ও পরম সাহসিকতার সঙ্গে মহানবী (সা.) তার মিশন এগিয়ে নিতে থাকেন।
‘দারুণ নদওয়া’ নামে মক্কার কাফিরদের একটি জায়গা নির্দিষ্ট ছিল। সেখানে জাতীয় সমস্যাবলি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ও শলাপরামর্শ করা হতো। প্রতিটি গোত্রের প্রধান ব্যক্তিরা তাতে উপস্থিত থাকত। মক্কার কাফেররা একদিন সর্বশেষ নীতিনির্ধারণের উদ্দেশ্যে তাদের ‘নদওয়া’ গৃহে সব গোত্রপতির বৈঠক আহ্বান করে। বৈঠকে বিভিন্ন ধরনের মতামত আসে। কেউ পরামর্শ দিল, ‘মুহাম্মদ (সা.)কে শৃঙ্খলিত করে কোনো ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখা উচিত।’ পরক্ষণে আবার কেউ মতামত দিল, ‘মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গীরা হয়তো আমাদের কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে এবং এর ফলে আমাদের পরাজয়ও ঘটতে পারে।’ কিন্তু ওই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান হয়। কেউ কেউ বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, ‘তাকে নির্বাসিত করা হোক।’ কিন্তু তিনি যেখানে যাবেন, সেখানেই তার অনুগামী বাড়তে থাকবে। আন্দোলনও যথারীতি সামনে অগ্রসর হবে—এ আশঙ্কায় ওই পরামর্শও নাকচ করা হলো। সবশেষে আবু জাহেল ভিন্নরকম পরামর্শ দিল, ‘নানা কৌশল করে আমরা মুহাম্মদকে আটকাতে চেয়েছি। কিন্তু সম্ভব হলো না। বরং তার কাজ বেড়েই চলছে। তাই মুহাম্মদকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়াই সবচেয়ে উচিত হবে।’ আবু জাহেল আরও বলল, ‘প্রতিটি গোত্র থেকে একজন করে যুবক নির্বাচন করা হবে, তারা সবাই একযোগে রাসুল (সা.)-এর ওপর হামলা করে তাকে হত্যা করে ফেলবে। ফলে তার রক্তপণ সব গোত্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যাবে। আর বনি হাশিম গোত্র সবার সঙ্গে একাকী লড়াই করে কিছুই করতে সক্ষম হবে না।’
সমবেত সবাই এ সিদ্ধান্তের ওপর সমর্থন ব্যক্ত করে। তারা জঘন্যতম কাজটা সম্পন্ন করতে প্রত্যেক গোত্রের শক্তিশালী যুবকদের নির্বাচন করে। এরপর ঘোষণা করে, মুহাম্মদকে যে জীবিত অথবা মৃত ‘নদওয়া’ গৃহে হাজির করতে পারবে, তাকে ১০০ উট পুরস্কার দেওয়া হবে। মক্কার সব গোত্রের শক্তিশালী যুবকরা একত্রিত হয়ে শপথ নেয়, সেদিন রাতেই মুহাম্মদ (সা.)-এর বাড়ি ঘেরাও করা হবে। সেদিনই তাকে চিরতরে শেষ করে দেওয়া হবে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে বলেন, ‘স্মরণ করো, কাফিররা তোমাকে বন্দি বা হত্যা করার জন্য কিংবা নির্বাসিত করার চক্রান্ত করে। তারা চক্রান্ত করে; আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেন। আর আল্লাহ শ্রেষ্ঠতম কৌশলী।’ (সুরা আনফাল, আয়াত: ৩০)। তাদের সব নীলনকশা ও কূটপরিকল্পনা মহান আল্লাহ নস্যাৎ করে দেন। রাতেই আল্লাহতায়ালা ওহির মাধ্যমে এই চক্রান্তের কথা তার রাসুলকে জানিয়ে দেন। তার প্রিয় নবী (সা.)-কে তিনি হিজরতের আদেশ দিয়ে বলেন, ‘হে নবী! মক্কার মানুষ আপনাকে চায় না। অন্যদিকে মদিনার মানুষ আপনার জন্য সীমাহীন আগ্রহে প্রতীক্ষা করছেন। আপনি হিজরত করে মদিনায় চলে যান।’
হিজরতের নির্দেশ পাওয়ামাত্রই প্রিয়নবী (সা.) নিজের ঘরে ও নিজের বিছানায় আপন চাচাতো ভাই হজরত আলি (রা.)-কে রাখেন। এরপর প্রিয়সঙ্গী আবু বকর (রা.)-কে নিয়ে মহানবী (সা.) মদিনার উদ্দেশে রওনা হন। রওনা হওয়ার মুহূর্তে বায়তুল্লাহর দিকে করুণ দৃষ্টিতে নবীজি বলেন, ‘হে মক্কা! খোদার কসম, তুমি আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় শহর, আমার প্রতিপালকের কাছেও বেশি পছন্দের শহর তুমি। যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিত, আমি কখনো বের হতাম না।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৩৯২৫)।
নবীজি (সা.) আল্লাহতায়ালার আদেশ পেয়ে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মক্কা মুকাররামা থেকে মদিনার উদ্দেশে হিজরত করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মোতাবেক ৮ রবিউল আউয়াল মদিনার পার্শ্ববর্তী কোবায় পৌঁছান। ২৭ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মোতাবেক ১২ রবিউল আউয়াল মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছান তিনি। মদিনায় সর্বপ্রথম হিজরত করেছেন রাসুল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবি মুসআব ইবনে উমাইর (রা.)। আর মহানবী (সা.) হিজরত করেন রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার। সাহাবাদের হিজরতের দুই মাস পর।
হিজরতের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন আবু বকর (রা.)। এ ছাড়া আবু বকর (রা.)-এর গোলাম আমের ইবনে ফুহাইরা এবং পথনির্দেশক আবদুল্লাহ ইবনে আরিকত দুয়ালি ছিলেন। মদিনার উদ্দেশে তিনি রওনা দেন ২৭ সফর। এটি বায়আতে আকাবার তিন মাস পর। তিন দিন মক্কার ‘গারে ছাওর’ গুহায় গোপন থাকার পর প্রথম রবিউল আউয়াল আবার রওনা দেন। ১২ রবিউল আউয়ালে মদিনার নিকটবর্তী কোবা অঞ্চলে পৌঁছান। সেখানে অবস্থান করে মসজিদে কুবা প্রতিষ্ঠা করেন। এদিকে মদিনার লোকজন তার আগমনের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে। প্রতিদিন তারা সকাল থেকে সূর্যের তাপ প্রখর হওয়া পর্যন্ত মদিনার বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করত। দূর দিগন্তে তাকিয়ে দেখত কোনো আগন্তুক আসছেন কি না। ১৪ দিন কুবায় থেকে মহানবী (সা.) ভরদুপুরে মদিনায় পৌঁছেন। মদিনার মানুষের মধ্যে তখন আনন্দ-উচ্ছ্বাসের জোয়ার নেমে আসে। তারা প্রিয়নবী (সা.)কে বরণ করে নিতে বিভিন্ন রকমের কবিতা আবৃত্তি করে। হৃদয়োৎসারিত উষ্ণতা দিয়ে শ্রেষ্ঠ মানুষকে অভ্যর্থনা জানায়। (ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ৩, পৃ. ১৮৮)
লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক