মনিরুলের বিশেষ যন্ত্রে জ্বলে অর্ধশতাধিক বাতি

2 weeks ago 10

স্লুইস গেটে স্রোতের মুখে বসানো হয়েছে ওয়ার্কশপে তৈরি করা বিশেষ এক যন্ত্র। পানির চাপে ঘুরছে সেটি। আর তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ। এই বিদ্যুৎ দিয়ে একসঙ্গে জ্বলছে অর্ধশতাধিক বাতি। প্রাকৃতিক শক্তিকে ব্যবহার করে অভিনব এই পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছেন বরগুনার মনিরুল ইসলাম। এতে উচ্ছ্বসিত গ্রামবাসী।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উদ্ভাবক মনিরুল ইসলাম বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের পুরাকাটা ফেরিঘাট এলাকার বাসিন্দা। প্রাইমারির গণ্ডি না পেরানো মনিরুল পেশায় স্থানীয় বাজারের জ্বালানি তেল ব্যবসায়ী। নিজ কৌতূহলে ২০০৬ সাল থেকে প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নানা গবেষণা চালিয়ে আসছেন তিনি।

মনিরুলের বিশেষ যন্ত্রে জ্বলে অর্ধশতাধিক বাতি

সবশেষ তিন মাসের প্রচেষ্টায় মাত্র ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে লোহার তৈরি যন্ত্রাংশ দিয়ে পায়রা নদীতে স্লুইস গেটে ওপর স্থাপন করে সফলভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছেন মনিরুল ইসলাম।

‘পায়রা নদীর পানি জোয়ারের সময় বৃদ্ধি পেয়ে স্লুইস গেটের মাধ্যমে ছোট খালে প্রবেশ করছে। প্রবাহমান সেই পানির গতিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্লুইস গেটের মুখে বসানো হয়েছে লোহার তৈরি বিশেষ ধরনের একটি ফ্যান। পানির স্রোতের ধাক্কায় ওই ফ্যান ঘুরলেই তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ। স্লুইস গেটের পাশেই ওই বিদ্যুতে জ্বলছে অর্ধশতাধিক বাতি।’

সরেজমিন মনিরুলের জল বিদ্যুৎ প্রকল্প ঘুরে দেখা যায়, পায়রা নদীর পানি জোয়ারের সময় বৃদ্ধি পেয়ে স্লুইস গেটের মাধ্যমে ছোট খালে প্রবেশ করছে। প্রবাহমান সেই পানির গতিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্লুইস গেটের মুখে বসানো হয়েছে লোহার তৈরি বিশেষ ধরনের একটি ফ্যান। পানির স্রোতের ধাক্কায় ওই ফ্যান ঘুরলেই তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ। স্লুইস গেটের পাশেই ওই বিদ্যুতে জ্বলছে অর্ধশতাধিক বাতি। এটি দেখতে ভিড় করছেন পথচারী ও স্থানীয়রা।

মনিরুল ইসলাম উদ্ভাবিত বিদ্যুৎ দেখতে আসা সোহাগ মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‌‘জোয়ার ভাটার পানির স্রোত দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা শুনে প্রথমে আমার বিশ্বাস হয়নি। এখন দেখি সত্যিই এখানে এতগুলো বাতি শুধুমাত্র এই পানির স্রোতের মাধ্যমে চলছে।’

মনিরুলের বিশেষ যন্ত্রে জ্বলে অর্ধশতাধিক বাতি

তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় প্রায়ই দুর্যোগ হয়। তখন অনেকদিন ধরেই বিদ্যুৎ থাকে না। মনিরুল ইসলাম উদ্ভাবিত এই বিদ্যুৎ গ্রামাঞ্চলে কাজে লাগানো উচিত। প্রতি গ্রামে যদি এরকম একটি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করে দেওয়া যায়, তাহলে সরকারের অনেক অর্থ সাশ্রয় হবে।’

‘আমি মূলত বাজারে খুচরা তেলের ব্যবসা করি। জ্বালানি তেলের খরচ বাঁচাতে নদীর জোয়ার-ভাটার স্রোত কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা শুরু করি ২০০৬ সালে। কিন্তু তখন নানা জটিলতায় আর সম্ভব হয়নি। পরে তিন মাসের প্রচেষ্টায় মাত্র ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে লোহার তৈরি যন্ত্র বসিয়ে সফল হয়েছি।’

পুরকাটা এলাকার বাসিন্দা ও মনিরুলের প্রতিবেশী কামাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মনিরুল আমার বাল্যবন্ধু। তার এ বিদ্যুৎ উদ্ভাবনের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ করতো। তবে এ কাজ সম্ভব না মনে করে তার কাথার কোনো গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু ও থেমে থাকেনি। গবেষণা করতে গিয়ে অনেক টাকাও খরচ করেছে। একান্ত প্রচেষ্টায় জ্বালানিবিহীন বিদ্যুৎ উৎপাদনে সে আজ সফল হয়েছে। তার এই উদ্ভাবন যদি সরকার পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে পারে, তাহলে শুধু বরগুনা নয়; ধীরে ধীরে পুরো দেশ জ্বালানিবিহীন এই বিদ্যুতে আলোকিত হবে।’

মনিরুলের বিশেষ যন্ত্রে জ্বলে অর্ধশতাধিক বাতি

কথা হয় মনিরুল ইসলামের কাজের সহযোগী ওয়ার্কশপ মিস্ত্রি মো. জাহিদের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘মনির ভাই আমার কাছে একদিন এসে বললেন, তিনি একটি যন্ত্র বানাবেন। যেটা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। আমি তাকে বলেছি, ভাই এটা হবে না; শুধু শুধু টাকা নষ্ট করার দরকার নেই। তাও তিনি আমাকে বললেন, না হলেও তিনি এটি বানাতে চান। পরে আমি বাধ্য হয়েই তার কথায় তার সঙ্গে কাজে যোগ দেই। তিনি যেভাবে নকশা দিতেন আমি সেভাবেই কাজ করাতাম। এটি বানানোর সময় অনেকে জিজ্ঞেস করতো কী বানাই। আমি লজ্জায় বলতাম, এটি ধান ভাঙার মাড়াই মেশিন। আজ অনেক ভালো লাগছে। ভাইয়ের এই উদ্ভাবন দেখতে মানুষ ভিড় করছে।’

স্বামীর সফলতার বিষয়ে মনিরুলের স্ত্রী তাসলিমা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিয়ের পর থেকেই দেখেছি তিনি বিভিন্ন যন্ত্র নিয়ে পড়ে থাকতেন। আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে তিনি আমাকে হঠাৎ বললেন, জোয়ার ভাটার পানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবেন। আমি তার কাজে কখনো বাধা দেইনি। তাই তাকে বলেছি, তুমি কাজ চালিয়ে যাও। এতে তিনি অনেক অর্থ ব্যয় করেছেন এবং দীর্ঘদিনের চেষ্টায় সফল হয়েছেন। এজন্য আমি গর্বিত।’

বিশেষ পদ্ধতিতে জল বিদ্যুতের উদ্ভাবক মনিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মূলত বাজারে খুচরা তেলের ব্যবসা করি। জ্বালানি তেলের খরচ বাঁচাতে নদীর জোয়ার-ভাটার স্রোত কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা শুরু করি ২০০৬ সালে। কিন্তু তখন নানা জটিলতায় আর সম্ভব হয়নি। পরে তিন মাসের প্রচেষ্টায় মাত্র ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে লোহার তৈরি যন্ত্র বসিয়ে সফল হয়েছি।’

মনিরুলের বিশেষ যন্ত্রে জ্বলে অর্ধশতাধিক বাতি

তিনি বলেন, ‘পানির উচ্চতা পাঁচ ফুট পার্থক্য হলেই বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। মেশিনের কিছু উন্নয়ন করলে তিন ফুট পার্থক্যেও বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। আমাদের নদীতে প্রতিদিন দুইবার জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পায়। এর মাধ্যমে ১৫-১৮ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। সরকারের সহযোগিতা পেলে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বিনা জ্বালানিতে গ্রাম থেকে গ্রাম আলোকিত করা সম্ভব।’

দেশের উপকূলীয় এলাকার সব নদী ও খালে বিশেষ এই পদ্ধতিতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব বলে জানান উদ্ভাবক মনিরুল ইসলাম। একইসঙ্গে প্রকল্পটি যুক্তিসঙ্গত ও বিজ্ঞানসম্মত কি-না তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য সরকার ও বিজ্ঞানীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড বরিশাল জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. গোলাম রব্বানী বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তেল গ্যাসসহ যা যা প্রয়োজন হয়, তার মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়া বাকি সবকিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় জ্বালানি সবই ব্যয়বহুল। গ্যাসের মজুতও ধীরে ধীরে কমবে। তবে প্রাকৃতিকভাবে সৌর, বায়ু এবং পানিশক্তিকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলে অনেক সাশ্রয় হবে।

এসআর/জেআইএম

Read Entire Article