‘মরার আবার জাত কী?’

7 hours ago 3

রাজবাড়ির সেই বিভীষিকাময় দুপুরের (৫ সেপ্টেম্বর) কথা ভাবলেই বুকের ভেতর কেমন যেন শূন্যতা জমে ওঠে। একদল উন্মত্ত মানুষ, ধর্মের নামে উগ্রতা আর অন্ধত্বে আক্রান্ত হয়ে, নুরান পাগলার মরদেহ কবর থেকে তুলে এনে প্রকাশ্যে জ্বালিয়ে দিল। এই আগুন শুধু একটি মৃতদেহকে পোড়ায়নি, পুড়িয়েছে আমাদের সমাজের মানবিকতা, সহনশীলতা আর বিবেকবোধকেও। শরৎচন্দ্রের সেই প্রশ্ন—“মরার আবার জাত আছে?”—আজও যেন আমাদের সমাজে উত্তরহীনই রয়ে গেল।

নুরান পাগলা কে ছিলেন, কী বলেছিলেন, তা হয়তো অনেকেই জানেন না। তিনি নিজেকে ইমাম মেহেদী দাবি করেছিলেন, ইসলাম নিয়ে বিতর্কিত কথা বলেছিলেন, বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিলেন—এমন অভিযোগ আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একজন মানুষ জীবিত অবস্থায় যেমনই হোক, মৃত্যুর পর তার প্রতি এমন অমানবিক আচরণ কি কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য? ধর্মের নামে, মতের নামে, ভিন্নতার নামে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি?

শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব সারা বিশ্বেই প্রকট। এই ব্রিটেনে শত-সহস্র মসজিদ কিংবা ইসলামী কালচারাল সেন্টার ছড়িয়ে আছে সারা দেশজুড়ে। এখানেও আছে শিয়াদের সুরম্য মসজিদগুলো । সম্প্রতি গিয়েছিলাম তিউনিসিয়ায়। আফ্রিকার সেই দেশটাতে দেড় হাজার বছরের পুরোনো এক ঐতিহ্যবাহী মসজিদ দেখতে গিয়েছিলাম। একটা কবরকে সেখানেও লাল কাপড় দিয়ে আচ্ছাদন করে রাখা আছে- একজন নাপিতের কবর, যিনি নবী হজরত মুহাম্মদ (সাল্লালাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) - এর দাড়ি মোবারক কেটেছেন বিভিন্ন সময়ে এবং কিছু দাড়ির (গালের লোম) সাথে নিয়ে এসেছিলেন বলে বিশ্বাস করেন সেখানকার শিয়া-সুন্নি সকল সম্প্রদায়ের মানুষ । শিয়া ধর্মাবলম্বীদের এক পবিত্র জায়গা এটা । এর পাশেই আছে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাজার বছর আগের পুরোনো এই বিশ্ববিদ্যালয় ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে, কোনো শিক্ষার্থী নেই-কিন্তু সারা পৃথিবীতে মুসলিম সভ্যতার অগ্রগতিতে এ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এক জগৎ বিখ্যাত নাম । সুন্নি অধ্যুষিত দেশটা হলেও  সরকারই এসব কিছু সুরক্ষা দেয়, দিয়ে আসছে শত-সহস্র বছর থেকে।

আমরা জানি, মতবিরোধ, বিভ্রান্তি, এমনকি ধর্মীয় ব্যাখ্যার ভিন্নতা নতুন কিছু নয়। যুগে যুগে ধর্মের ব্যাখ্যা এসেছে, বিতর্ক হয়েছে, মতের সংঘাত হয়েছে। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব, আহলে হাদিস-ব্রেলভি মতবিরোধ—এসব তো শুধু আমাদের দেশে নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বেই বিদ্যমান। ব্রিটেনের মসজিদগুলো, তিউনিসিয়ার হাজার বছরের পুরোনো মসজিদ, মসজিদের পাশে 'নাপিতের কবর' হিসেবে শ্রদ্ধার সাথে মুসলিম বিশ্বে উচ্চারিত এই কবর কিংবা  শিয়া-সুন্নি মিলেমিশে এক কবরকে সম্মান জানানো—এসব উদাহরণ দেখায়, ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও সহাবস্থান সম্ভব। রাষ্ট্র সেখানে সুরক্ষা দেয়, মানুষ শ্রদ্ধা জানায়, কেউ কারও কবর তুলে আগুন দেয় না।

কিন্তু বাংলাদেশে? এখানে ধর্মের নামে বিভাজন, রাজনীতির নামে উস্কানি, আর ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্ব ইজতেমার দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, মাজার নিয়ে বিরোধ, কিংবা ধর্মীয় বক্তাদের পারস্পরিক হিংসা—এসব আমাদের সমাজকে ক্রমশ অস্থির করে তুলছে। ধর্ম এখানে আর কেবল বিশ্বাসের জায়গা নয়, হয়ে উঠেছে রাজনীতির হাতিয়ার। ভারতের বিজেপি হিন্দুত্বকে ব্যবহার করে, মধ্যপ্রাচ্যে পরাশক্তিরা ইসলামের বিভাজনকে কাজে লাগায়, আর আমাদের দেশে ধর্মের নামে মানবিকতা ভুলে গিয়ে মানুষ হয়ে উঠছে পশুর চেয়েও হিংস্র।

রাজবাড়ির এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদের সমাজে কতটা গভীর অসহিষ্ণুতা, কতটা ভয়ংকর অমানবিকতা বাসা বেঁধেছে। এই আগুন শুধু নুরান পাগলার দেহ নয়, আমাদের বিবেক, আমাদের মানবিকতাকেও পুড়িয়ে দিয়েছে।  আমরা যেন এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। সরকারকে দ্রুততম সময়ে এই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনাটাই হবে এসময়ের অন্যতম প্রধান কাজ। সমাজের প্রতিটি স্তরে মানবিক মূল্যবোধ, সহনশীলতা, এবং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠা করতে এ কাজটা সরকার করবে এই প্রত্যাশাটা আমরা করতেই পারি।

রাজবাড়ির এই ঘটনা তাই শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং আমাদের সমাজের গভীর অসুখের প্রতিচ্ছবি। কবর থেকে মরদেহ তুলে আগুনে পোড়ানো—এটা কেবল আইন-শৃঙ্খলার ব্যর্থতা নয়, এটা আমাদের নৈতিকতার, আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিরও চরম পরাজয়। ধর্মের নামে যারা এই বর্বরতা চালায়, তারা আসলে ধর্মের শত্রু, মানবতার শত্রু। অথচ, আমাদের ইতিহাস বলে, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা, সহনশীলতা, এবং মানবিকতা—এটাই ছিল আমাদের সমাজের মূল ভিত্তি।

আমার নিজের গ্রামের কথাই বলি। সেখানে একটি ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক আধ্যাত্মিক পুরুষের কবরকে কেন্দ্র করে। এই মাজার কিংবা প্রতিষ্ঠানটির একটা খ্যাতিও আছে গোটা সিলেট অঞ্চলে । শতাধিক বছর ধরে সেই কবর ঘিরে আছে একটা কিংবদন্তি, কিছুটা মতভেদও আছে, কিন্তু এ নিয়ে কেউ কোনো বিতর্ক তোলে নি কখনও।  অশ্রদ্ধাতো দেখানোর প্রশ্নই উঠে না। স্থানীয় প্রশাসনকে কোনো ব্যাপারে কখনও হস্তক্ষেপ করতে হয়নি। গ্রামের মানুষ নিজেরাই সম্মান, সহযোগিতা, আর সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই প্রতিষ্ঠানটির এমনকি জৌলুস বাড়াতেও। এটাই তো ধর্মের শিক্ষা—ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা, মানবিকতা, এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

কিন্তু আজ আমরা কোথায়? ধর্মের নামে যারা বিভ্রান্তি ছড়ায়, যারা রাজনীতির কূটচালে ধর্মকে ব্যবহার করে, তারা আসলে সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। তারা ইসলামের সেবক নয়, বরং ইসলামের ক্ষতিসাধনকারী। তাদের হাতে ধর্মের পবিত্রতা, মানবিকতা, আর সহনশীলতা বারবার অপমানিত হচ্ছে। রাজনীতির এই কুটচাল, ধর্মের নামে বিভ্রান্তি, আর মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়—এসবের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

রাজবাড়ির এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদের সমাজে কতটা গভীর অসহিষ্ণুতা, কতটা ভয়ংকর অমানবিকতা বাসা বেঁধেছে। এই আগুন শুধু নুরান পাগলার দেহ নয়, আমাদের বিবেক, আমাদের মানবিকতাকেও পুড়িয়ে দিয়েছে।  আমরা যেন এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। সরকারকে দ্রুততম সময়ে এই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনাটাই হবে এসময়ের অন্যতম প্রধান কাজ। সমাজের প্রতিটি স্তরে মানবিক মূল্যবোধ, সহনশীলতা, এবং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠা করতে এ কাজটা সরকার করবে এই প্রত্যাশাটা আমরা করতেই পারি।

না হলে, আজ রাজবাড়ি, কাল হয়তো আমাদেরই কোনো গ্রাম, কোনো শহর, কিংবা আমাদেরই কোনো আপনজন—এই অন্ধ উন্মত্ততার শিকার হবে। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার নয়, মানবিকতার আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের বিবেক, আমাদের মানবিকতা— এই আগুনের লেলিহান শিখায় আর যেন না পুড়ে যায়, সেই শপথটাই প্রয়োজন এখন।

লেখক : বৃটেনপ্রবাসী কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম

Read Entire Article