মহানবীর জীবনে মানবতার মুক্তির দিশা

4 hours ago 5
আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আরব উপদ্বীপসহ সমগ্র বিশ্বে যখন চরম উচ্ছৃঙ্খলতা, পাপাচার, ব্যভিচার, মিথ্যা, হত্যা, লুণ্ঠন, মদ্যপান, জুয়া, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, নৈরাশ্য আর হাহাকার বিরাজ করছিল, ঠিক তখন মানবতার মুক্তির দিশারি সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বমানবতার শান্তির দূত হয়ে আবির্ভূত হলেন। রাসুল (সা.) হলেন বিশ্বমানবতার জন্য আল্লাহর এক অনন্য রহমতস্বরূপ প্রেরিত। মহান বিশ্বপরিচালক ঘোষণা করেছেন, ‘আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি বিশ্বজগতের জন্য বিশেষ রহমতস্বরূপ।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ১৭০)। আর মহানবী (সা.) ছিলেন মানবজাতির অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় মহান উদার, বিনয়ী ও নম্র ব্যক্তিত্ব। তিনি উত্তম চরিত্র ও মহানুভবতার একমাত্র আধার। পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, প্রতিবেশী সবার অকৃত্রিম শিক্ষণীয় আদর্শ ও প্রাণপ্রিয় ব্যক্তিত্ব নবী করিম (সা.) একাধারে সমাজ সংস্কারক, ন্যায়বিচারক, সাহসী যোদ্ধা, দক্ষ প্রশাসক, যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক এবং সফল ধর্ম প্রচারক। কল্যাণকর প্রতিটি কাজেই তিনি সর্বোত্তম আদর্শ। তার অসাধারণ চারিত্রিক মাধুর্য ও অনুপম ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব, আয়াত: ২১)। তিনি অবিস্মরণীয় ক্ষমা, মহানুভবতা, বিনয়-নম্রতা, সত্যনিষ্ঠতা প্রভৃতি বিরল চারিত্রিক মাধুর্য দিয়েই বর্বর আরব জাতির আস্থাভাজন হতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে কারণে তারা তাকে ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বস্ত উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তিনি যে বিনয়-নম্র ও সৎ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, তা তারা একবাক্যে অকপটে স্বীকার করেছে। দুনিয়ার মানুষকে অর্থের দ্বারা বশীভূত না করে বরং তাদের সদাচরণ, উত্তম ব্যবহার এবং সততার দ্বারা বশীভূত করতে সক্ষম হয়েছেন। তার চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সুরা কালাম, আয়াত: ৪)। আত্মমর্যাদাবোধবশত কখনো তিনি মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান ও হেয়প্রতিপন্ন করেননি বা নগণ্য ভাবেননি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করে পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠতর স্বভাব-চরিত্রের অতুলনীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন। তার স্বভাব-চরিত্রের মধ্যে বিনয় ও নম্রতা ছিল সদাজাগ্রত। সর্বোত্তম আদর্শের বাস্তবায়নকারী ও প্রশিক্ষক হিসেবেই তাকে বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছিল। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত)। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন আচার-আচরণে অত্যন্ত বিনয়ী। কখনো দুর্বল ব্যক্তিকে কটু কথার মাধ্যমে হেয়প্রতিপন্ন করতেন না। এমনকি কোনো মানুষকে তার সামর্থ্যের বাইরে অসাধ্য কাজে বা কঠিন দায়িত্বে বাধ্য করতেন না। তিনি দরিদ্র অসহায় মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন। সমাজে যে যতটুকু মর্যাদার অধিকারী, তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করতেন। তিনি নম্রতাসুলভ আচরণ প্রদর্শন করার জন্য সাহাবায়ে কেরামদের উপদেশ দিতেন, আচার-ব্যবহারে অযথা রাগ ও ক্রোধ থেকে সর্বদা বিরত থাকার পরামর্শ দিতেন। তিনি মানুষকে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নম্র-বিনয়ী হয়, আল্লাহ তাকে উচ্চাসনে আসীন করেন আর যে অহংকারী হয়, আল্লাহ তাকে অপদস্থ করেন।’ (মিশকাত) তার কাছ থেকে বিধর্মীরাও আশাতীত সুন্দর কোমল আচরণ লাভ করত। তিনি এতই নমনীয় ও কোমলতর ব্যবহারের অধিকারী ছিলেন যে, তার পবিত্র সংস্রব কিংবা সামান্যতম সুদৃষ্টির কারণেও অনুসারীরা তাকে প্রাণাধিক ভালোবাসত এবং মনেপ্রাণে গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করত। তার কোমল ব্যবহার সম্পর্কে উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবী করিম (সা.) কঠোর ভাষী ছিলেন না, এমনকি প্রয়োজনেও তিনি কঠোর ভাষা প্রয়োগ করতেন না। প্রতিশোধপ্রবণতা তার মধ্যে আদৌ ছিল না। মন্দের প্রতিবাদ তিনি মন্দ দিয়ে করতেন না, বরং মন্দের বিনিময়ে তিনি উত্তম আচরণ করতেন। তিনি ক্ষমাকে প্রাধান্য দিতেন। তিনি এতটা বিনয়ী ও নম্র ছিলেন যে, কথা বলার সময় কারও মুখমণ্ডলের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করে কথা বলতেন না। কোনো অশোভন বিষয় উল্লেখ করতেন না।’ (মেশকাত)। তিনি সবসময় মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন ও সদালাপ করতেন। তার মধুর বচনে সবাই অভিভূত হতো। তার অভিভাষণ শুনে জনসাধারণ অশ্রু সংবরণ করতে পারত না। তিনি জনগণকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন, ‘দয়ালু প্রভু আল্লাহর ইবাদত করো, ক্ষুধার্তকে খাদ্য প্রদান করো, সালামের বহুল প্রচলন করো এবং এসব কাজের মাধ্যমে বেহেশতে প্রবেশ করো।’ (বোখারি)। একদা এক ব্যক্তি নবী করিম (সা.)-কে ইসলামে সবচেয়ে ভালো কাজ কোনটি প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে জানালেন, ‘অভুক্তকে খাওয়ানো আর চেনা-অচেনা সবাইকেই সালাম করা।’ (বোখারি ও মুসলিম)। তিনি ছিলেন নির্লোভ, নিরহংকার, পরোপকারী, সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন আদর্শ মহামানব। একবার এক ব্যক্তি নবী করিম (সা.)-এর দরবারে এসে তার ইস্পাতকঠিন ব্যক্তিত্ব ও গাম্ভীর্য লক্ষ করে ভয়ে কাঁপতে লাগল। এতদর্শনে তিনি লোকটিকে স্বাভাবিক করে তোলার জন্য বললেন, ‘থামো, নিজেকে সংযত করো! আমি তো এমন এক মহিলার গর্ভজাত সন্তান, যিনি শুকনো গোশত ভক্ষণ করতেন।’ (তিরমিজি)। মানুষের সঙ্গে এমন সদাচরণ একান্তই উদারতার পরিচায়ক। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম বিরল ব্যক্তিত্বের সন্ধান কখনো মেলে না। এমনিভাবে তিনি মানুষের প্রতি কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা ওহির মাধ্যমে আমার কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছেন যে, নম্রতা অবলম্বন করো। কেউ যেন অন্যের ওপর গর্ব ও অহংকারের পথ অবলম্বন না করে এবং কেউ যেন কারও ওপর জুলুম না করে।’ (মুসলিম)। তিনি বহুলাংশেই স্বাবলম্বী ছিলেন। নিজের প্রয়োজনে কারও ওপর নির্ভরশীল হতেন না। নিজ হাতে জুতা মেরামত করতেন, কাপড় সেলাই করতেন, দুধ দোহন করতেন। সেবকদের কাজে সহায়তা করে আটা পিষতেন। নিজ হাতে রুটি তৈরি করে পরিবার-পরিজনকে নিয়ে খেতেন। নিজে হাটবাজার থেকে সওদা করে নিয়ে আসতেন। পরিবারের কেউ কোনো কাজের সহায়তা কামনা করলে তখনই সাহায্যের জন্য সাড়া দিতেন। রাসুল (সা.) নিজের ব্যাপারে বলেন, ‘আমাকে ছয়টি এমন ফজিলত দেওয়া হয়েছে, যা অন্য কোনো নবী-রাসুলকে দেওয়া হয়নি—১. আমাকে জাওয়ামিউল কালিম দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ রাসুল (সা.)-এর কথামালা এমন সাহিত্যপূর্ণ যে, বাক্য ছোট হলেও তার ভেতরে অনেক অর্থ নিহিত; ২. আমাকে এক মাসের দূরত্ব পর্যন্ত ভয় দ্বারা মদদ করা হয়। অর্থাৎ কোনো দুশমন এক মাসের দূরত্বে অবস্থান করেও আমার ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে; ৩. আমার জন্য পুরো জমিনকে মসজিদস্বরূপ ও পবিত্রকারী বানিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ পৃথিবীর যে কোনো স্থানে যে কেউ নামাজ আদায় করতে চায়, নামাজ আদায় করতে পারবে এবং যে কোনো স্থান থেকে যে কেউ তায়াম্মুম দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করতে চায়, অর্জন করতে পারবে; ৪. আমার জন্য গনিমতের মাল হালাল করা হয়েছে। অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে যে সম্পদ দুশমনের কাছ থেকে মুসলিমদের হাতে আসে, তা হলো গনিমতের মাল। তা আগের মুসলিমদের জন্য হালাল ছিল না। কিন্তু আমার জন্য হালাল করা হয়; ৫. আমাকে শাফায়াত দান করা হয়। অর্থাৎ কেয়ামতের দিন মুহাম্মদ (সা.)কে বান্দাদের কল্যাণে সুপারিশ করার জন্য শাফায়াতে কুবরা দান করা হবে; ৬. পূর্বের নবীগণ নির্দিষ্ট গোত্র-জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। আর আমি পুরো মানবজাতির জন্য প্রেরিত এবং শেষ নবী হিসেবে প্রেরিত। আমার পরে অন্য কোনো নবী আসবে না (বোখারি: ৪২৫)। হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা আমাকে দুনিয়াতে উত্তম চরিত্র এবং ভালো কাজগুলোকে পরিপূর্ণ করার জন্য প্রেরণ করেছেন। (মুসতাদরাকে হাকেম)। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, গৌরব করে নয়, শুকরিয়া আদায় করে বলছি, আমি আল্লাহর বন্ধু। আমি কেয়ামতের দিন আল্লাহর হামদ-প্রশংসার ঝাণ্ডা ওঠাব। যার নিচে আদম (আ.)সহ সব মানুষ একত্রিত হবে। আমিই সর্বপ্রথম সুপারিশকারী। সর্বপ্রথম আমার সুপারিশই কবুল করা হবে। আমিই প্রথমে জান্নাতের দরজার কড়া নাড়ব এবং আমার জন্য দরজা খোলা হবে। অতঃপর জান্নাতে আমাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে এবং আমার সঙ্গে গরিব মুসলিমরাও থাকবে। আমি পূর্বাগত ও কেয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সমগ্র মানবজাতিতে সর্বাধিক সম্মানিত। এসব কিছু গৌরব করে নয় বরং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেই বলছি (তিরমিজি শরিফ)। মৃত্যুর পর নাজাত পেতে হলে আল্লাহকে এক স্বীকার করে মুহাম্মদ (সা.)কে আল্লাহর প্রেরিত শেষ রাসুল হিসেবে মেনে নিয়ে ইসলামকে অনুসরণ করতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের উচিত রাসুল (সা.)-এর আদর্শ মোতাবেক জীবনধারণ করা। মহান আল্লাহ তার অনুপম জীবনাদর্শকে আমাদের সামগ্রিক জীবনে চলার পথের পাথেয় করুন। লেখক: ইমাম ও খতিব
Read Entire Article