‘ওপার বাংলার আইয়ুব বাচ্চু দমদমে অনুষ্ঠান করতে এসেছিলেন। তার আগে আমি অনুষ্ঠান করি। কিন্তু মনে আছে, তার শো শুরু হওয়ার পর আমি মাটিতে বসে পড়েছিলাম। পরে পরমদা আমাকে একটা চেয়ারে বসার ব্যবস্থা করে দেন। আমি বলতে চাইছি, তখন আইয়ুব বাচ্চু আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, কোথায় বসছি সেটা নয়।’
কথাগুলো লিখেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কণ্ঠশিল্পী লগ্নজিতা চক্রবর্তী। ‘বসন্ত এসে গেছে’, ‘প্রেম পড়া বারণ’সহ অনেক মিষ্টি বাংলা গানের শিল্পী তিনি। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট করে কটাক্ষের শিকার হন এই শিল্পী। ওই পোস্ট করতেই তাকে উপহাস ও নিন্দা করতে শুরু করে কিছু মানুষ। ফলাফল, পোস্টগুলো মুছে ফেলেন তিনি। ঘটনায় ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন তিনি। তা নিয়ে লিখেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পোর্টাল আনন্দবাজার অনলাইনে।
লগ্নজিতা লিখেছেন, ভেবে অবাক হচ্ছি, মানুষের মধ্যে কত ঘৃণা জমে রয়েছে! সে রাতে ফেসবুকে ভারত-বাংলাদেশের সম্প্রীতিবিষয়ক একটি পোস্ট করার পর থেকেই দেখলাম, ট্রলিং শুরু হল। তারই জবাবে রোববার আরও কয়েকটা পোস্ট করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম, আমি কোনোভাবেই আলোচনা থামাতে পারব না। কারণ সব সময়ই মনে হয়েছে, এই কঠিন সময়ে মানুষ রেগে রয়েছেন। শেষ পর্যন্ত আমার পরিবার এবং ব্যান্ডের সদস্যদের অনুরোধে যাবতীয় পোস্ট মুছে দিলাম সমাজমাধ্যম থেকে।
ঘটনাটির ব্যাখ্যা দিয়ে শিল্পী লিখেছেন, ‘এই পুরো ঘটনায় কয়েকটা বিষয় আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, আমরা অনেক সময়ই পরিস্থিতির তুলনায় নিজেদের অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। তাই মতামতের আদান-প্রদানও চলতে থাকে। আমার পোস্টে একের পর এক নেতিবাচক মন্তব্য দেখে আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম। মনখারাপ হয়ে যাচ্ছে এই ভেবে যে, এখনও এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্যের প্রতি কতটা অসম্মান পুষে রাখেন মনের ভেতর। বারবার আমাকে বলা হল, আমি দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত এলাকার বাসিন্দা। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে নাকি সবটা বিচার করা উচিত। আমার প্রশ্ন, প্রত্যেক মানুষের বাস্তবতার একটা পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। এটা ঠিক, আমার জীবনের সত্যের থেকে হয়তো মুর্শিদাবাদের গ্রামের মানুষের বাস্তবতা আলাদা। হতেই পারে। কিন্তু আমি শুধু আমার সত্যকে সম্বল করে কিছু কথা বলেছিলাম। তাতে কারও সমস্যা হলে, আমার সত্যিই কিছু বলার নেই।’
বাংলাদেশের অনুরাগীদের স্মরণ করতেও ভোলেননি লগ্নজিতা। ভোলেননি বাংলাদেশের প্রয়াত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর কনসার্টে গান শোনার অভিজ্ঞতার কথাও। সেসব প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘কলকাতার যেকোনো বাঙালি শিল্পীর পোস্ট করা গানের নিচে মন্তব্য লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, অর্ধেক যদি এপার বাংলার বাঙালিদের মন্তব্য আসে, তা হলে বাকিটা ওপারের। আমি এখনও বাংলাদেশে গিয়ে অনুষ্ঠান করার সুযোগ পাইনি। কয়েক বছর আগে ওপার বাংলার আইয়ুব বাচ্চু দমদমে অনুষ্ঠান করতে এসেছিলেন। তার আগে আমি অনুষ্ঠান করি। কিন্তু মনে আছে, তার শো শুরু হওয়ার পর আমি মাটিতে বসে পড়েছিলাম। পরমদা (অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) সঞ্চালক ছিলেন। পরে তিনিই আমাকে একটা চেয়ারে বসার ব্যবস্থা করে দেন। আমি বলতে চাইছি, তখন আইয়ুব বাচ্চু আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, কোথায় বসছি সেটা নয়।’
শিল্পী হিসেবে নানান ঘটনায় কটাক্ষের শিকার হওয়া প্রসঙ্গেও লিখেছেন তিনি। লগ্নজিতা লেখেন, ‘অনেকেই এখন বলেন, শিল্পীরা হলেন “সফট টার্গেট”। কোনো জিনিসের ভালো এবং খারাপ, দুই নিয়ে পথচলায় আমি বিশ্বাসী। আমি নিজেকে শিল্পী বলে পরিচয় দিয়ে থাকি। কিন্তু কোনো দিনই নিজেকে তারকা মনে করি না। হয়তো কিছু মানুষ আমাকে চেনেন। শিল্পী হিসেবে মানুষ আমাকে ভালোবাসেন বলে জীবনে অনেক সুবিধাও আমি পাই। সুবিধা যদি হাসিমুখে মেনে নিই, তা হলে অসুবিধাও আমাকে মেনে নিতে হবে।’
দুই বাংলার মানুষের সম্প্রীতি প্রসঙ্গে লগ্নজিতা লিখেছেন, ‘একটা জিনিস স্পষ্ট করে দিই। এই সব কটাক্ষ কিন্তু আমাকে নাড়া দেয়নি। বরং মানুষের প্রতি মানুষের এই ঘৃণা দেখে আমি বিচলিত। কেউ বলতেই পারেন, তা হলে আমি কেন একের পর এক পোস্ট করলাম? আমি কাউকে জবাব দিতে চাইনি। আমার আশপাশের মানুষ যে এতটা অসহিষ্ণু, সেটা ভেবে কষ্ট পেয়েছি। তাই পোস্ট করেছি। ইতিহাস আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমার প্রশ্ন, আমরা কি এতটা তীব্র রাগ নিয়েই বেঁচে থাকব? আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও কি এই রাগের উত্তরাধিকার দিয়ে যাব?’
লগ্নজিতার প্রত্যাশা, বিক্ষুব্ধ মানুষের রাগ একদিন কমবে। তিনি লিখেছেন, ‘মানুষ এখন রেগে রয়েছেন। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি তো তাদের আরও মারামারি করতে বলতে পারি না। আমি সেখানে সম্প্রীতির বার্তাই দিতে পারি। সেটাই করেছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, একদিন পৃথিবী আবার শান্ত হবে। তখন আবার জেমস পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠান করতে আসবে। আবার এপার বাংলার শিল্পীরা ওপার বাংলায় অনুষ্ঠান করতে যাবেন। এখন সম্ভব না হলেও গত ৯ বছরে আমি যত বাংলাদেশি শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছি, তারা নিশ্চয়ই আমাকে ভুলে যাবেন না। শান্তি ফিরে এলে, তাদের সঙ্গে কাজের সুযোগ হলে আমি নিশ্চয়ই আবার তাদের সঙ্গে কাজ করব। দুই বাংলা আবার একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করবে।’
আরএমডি/জিকেএস