রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) কার্যালয়ের সব সেবা যেন দালালচক্রে আটকা পড়েছে। বিআরটিএর এ কার্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে শুরু করে সর্বত্রই দালালের দৌরাত্ম্য। এর সঙ্গে বিআরটিএ কার্যালয়ে অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে বলে দাবি ভুক্তভোগীদের। ভোগান্তি এড়াতে সেবাগ্রহীতারাও দ্বারস্থ হচ্ছেন দালালের।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, নিয়ম মেনে কাজ করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। পাশাপাশি নানান কাগজ (ডকুমেন্টস) চান সংশ্লিষ্টরা। এসব ভোগান্তি এড়িয়ে দ্রুত সময়ে কাজ করতে দালালের সহায়তা নেন তারা।
সম্প্রতি বিআরটিএ কার্যালয়ে সাড়ে ৪ ঘণ্টারও বেশি সময় অবস্থান করে ভুক্তভোগী, দালাল ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক। বিআরটিএ কার্যালয়ে প্রবেশ করতেই এক যুবক এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘লাইসেন্সের কাজ করবেন ভাই?’ এসময় এ কার্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে শুরু করে সর্বত্রই দালাল চক্রের সদস্যদের উপস্থিতি চোখে পড়ে। যদিও দালালের দৌরাত্ম্য বন্ধে দুদক ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থা মাঝেমধ্যে অভিযান চালায়, তবে অভিযান শেষে আবারও ফিরে আসে সেই আগের চিত্র।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, নিয়ম মেনে কাজ করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। পাশাপাশি নানান ডকুমেন্টস চান সংশ্লিষ্টরা। এসব ভোগান্তি এড়িয়ে দ্রুত সময়ে কাজ করতে দালালের সহায়তা নেন তারা।
মিরপুরে বিআরটিএর এ কার্যালয়ে প্রতিদিন সেবা নিতে আসেন হাজারও মানুষ। তবে এখানে স্বাভাবিক সেবা পেতে বড় বাধা দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পূর্ণরূপে ডিজিটালাইজেশনই দালাল নির্মূলের একমাত্র সমাধান। তবে সেবাপ্রার্থীরা জানান, ভোগান্তি কমিয়ে দ্রুত সময়ে কাজ করাতে ও কাগজ সংক্রান্ত ঝামেলা সমাধানে দালাল চক্রের সহায়তা নেন তারা।
কথা হয় ড্রাইভিং লাইসেন্স সংক্রান্ত কাজে আসা নজরুল ইসলামের সঙ্গে। লাইসেন্স করতে প্রয়োজনীয় একটি কাগজের মূল কপি বাসায় রেখে ফটোকপি সঙ্গে আনেন তিনি। তবে ডকুমেন্টের মূল কপি ছাড়া লাইসেন্স হবে না বলে জানিয়েছেন বিআরটিএ কর্মকর্তারা। পরক্ষণেই এক যুবক নজরুল ইসলামের কাছে এসে জানান তিনি লাইসেন্স করে দিতে পারবেন। তবে দরদামে না মেলায় ওই যুবককে দিয়ে কাজ করাননি তিনি।
- আরও পড়ুন
গাড়ি না দেখেই ফিটনেস সনদ, বিআরটিএ কার্যালয়ে দুদকের অভিযান
দুদকের অভিযানেও কমেনি দালালের দৌরাত্ম্য
বিআরটিএ’র অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে লাইসেন্স পাচ্ছে অপরাধীরা
জাগো নিউজকে নজরুল ইসলাম বলেন, একটা কাগজের অরিজিনাল কপি ভুলে বাসায় রেখে এসেছি, ফটোকপি এনেছি। তবে অরিজিনাল কপি ছাড়া লাইসেন্স হবে না বলে জানিয়েছেন বিআরটিএ কর্মকর্তা।
ওই যুবকের (দালাল চক্রের সদস্য) সঙ্গে কী কথা হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, অরিজিনাল কপি ছাড়াই সে লাইসেন্স করে দেবে বলেছে। এজন্য ২ হাজার টাকা চেয়েছে। বলেছি করবো না।
যে কোনো অফিসে এখন আমি উইদাউট নোটিশে ভিজিট করছি। সেখানে যদি কোনো ধরনের দালাল চক্রের সম্পৃক্ততা পাই তাহলে তখনই গ্রেফতার করছি এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। দালাল নির্মূলে আমরা সর্বদা চেষ্টা করছি। - বিআরটিএ চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ
একই স্থানে আরেক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় ওই যুবকের। তাকেও বারবার বলছিলেন, ‘কী লাগবে, এদিকে আসেন।’ এরপর ওই ব্যক্তির কাগজ দেখে বললেন, বেশি লাগবে না চাচা, ১৫০ টাকা দিয়েন। তবে তিনি রাজি না হওয়ায় ওই যুবক বলেন, ‘আচ্ছা ১০০ টাকা দিয়েন চাচা, ভাইস্তা হিসেবে ১০০ টাকা খামু।’
এ ঘটনার কিছুক্ষণ পর সেবাগ্রহীতা সেজে দালাল চক্রের এক সদস্যের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের। ড্রাইভিং লাইসেন্স কত দিনে করে দিতে পারবেন জানতে চাইলে দালাল চক্রের ওই সদস্য বলেন, যদি লার্নার (শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স) করেন তাহলে দুই মাস পরে আপনার ফিঙ্গারের পরীক্ষার তারিখ পড়বে। আর্জেন্ট হলে এক সপ্তাহ বা ১৫ দিনে নিতে পারবেন। এখন আপনি কীভাবে নিতে চান, কী কারণে নিতে চান- এসব জানালে স্যারের (বিআরটিএ অফিসের কর্মকর্তা) সঙ্গে কথা বলতে পারবো। তাহলে জিনিসটা ঠিকমতো হলো আর কী।
কথা হয় আরেক সেবাগ্রহীতার সঙ্গে। দালাল চক্রের সহায়তা নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, নিয়ম মেনে কাগজপত্র জমা দিলে দিন-সপ্তাহ পার হয়ে যায়। অথচ দালালের মাধ্যমে কাজ করালে ঘণ্টা পেরোনোর আগেই কাগজপত্র তৈরি হয়ে যায়। মূলত ভোগান্তি এড়াতে মানুষ দালালের মাধ্যমে কাজ করে।
- আরও পড়ুন
৬ বছরে শত কোটি টাকার মালিক জনস্বাস্থ্যের ড্রাফটম্যান শাহিন
আইন আছে সাজা নেই, পেট বাড়ছে পাথরখেকোদের
ফাঁদে সফলতা ‘শূন্য’, বেড়েছে দুর্নীতি মামলা
সেবাপ্রার্থী ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সাধারণত বিআরটিএ কার্যালয়ে লাইসেন্সের কাজে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাগজের ত্রুটি ধরা পড়ে। বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখিয়ে কাজ আটকে দেয়। পরীক্ষায় ছোট ভুলেও ফেল করানো হয়। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে একেক ধাপের পরীক্ষা দিতে হয়। এতে নানান ভোগান্তির শিকার হতে হয়। অথচ টাকা দিলে কোনো ভোগান্তি ছাড়াই দালাল চক্রের সদস্যরা সহজেই এগুলো করে দেন।
বিআরটিএর কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দালাল চক্রের সদস্যরা এসব কাজ করে থাকেন বলেও অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
চলতি বছরের ২০ মার্চ অনলাইনে ৭৫৯ টাকা পেমেন্ট করে আবেদন জমা দেন এই প্রতিবেদক। আবেদনের দুই মাস পর ২১ মে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ফিজিক্যাল টেস্টসহ অন্যসব পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। সেদিন দীর্ঘ লাইন ঠেলে একে একে সব কাজ শেষ করেন এ প্রতিবেদক। সাধারণত সব বিষয়ে উত্তীর্ণ হলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সরকার নির্ধারিত ৪ হাজার ৬২৫ টাকা পরিশোধ করলে ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা যায় গাড়ি চালানোর অনুমতি বা লাইসেন্স। তবে সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর সাড়ে তিন মাস পেরিয়ে গেলে এখন পর্যন্ত মেলেনি ই-লাইসেন্স কার্ড।
এ বিষয়ে কথা বলতে মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে একাধিকবার মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে আরেক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আমাদের কথা বলা নিষেধ। রোড সেফটি শাখার শীতাংশু শেখরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের পরিচালক (রোড সেফটি ও ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাসকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এছাড়া মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, যে কোনো অফিসে এখন আমি উইদাউট নোটিশে ভিজিট করছি। সেখানে যদি আমরা কোনো ধরনের দালাল চক্রের সম্পৃক্ততা পাই তাহলে তখনই গ্রেফতার করছি এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটদেরও বলা আছে তারা যে কোনো সময় ঝটিকা ভিজিট করবেন। দালাল নির্মূলে আমরা সর্বদা চেষ্টা করছি।
কেআর/কেএসআর/এমএফএ/জেআইএম