দেশে তালাকের হার বাড়ছে। বেড়েছে মেহেরপুর জেলাতেও। মেহেরপুরে বর্তমানে প্রতি ৪ ঘণ্টা ১৫ মিনিটে একটি করে তালাক হচ্ছে। ঠিক এক বছর আগে হিসাবটি ছিল প্রতি ৫ ঘণ্টায় একটি। তালাকের হার বেড়েছে, বিষয়টি উদ্বেগের।
তবে আরও উদ্বেগের বিষয় চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে মেহেরপুর জেলাতে বিশেষ একটি কারণ দেখিয়ে ৬৬ জন নারী তাদের স্বামীকে তালাক দিয়েছেন। আর কারণটি হলো অনলাইন জুয়া ও ক্যাসিনোতে সম্পৃক্ততা।
মেহেরপুর পৌর শহরের মিম তার স্বামী আনাম বায়েস নিশানকে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে তালাক দেন। এফিডেভিটে স্বামীকে তালাক দেওয়ার কারণ হিসেবে লিখেছেন মাদকাসক্ত এবং অনলাইন জুয়াড়ি।
কালাচাঁদপুরের মুন্নী তার স্বামী আশিক মিয়াকে তালাক দেওয়ার কারণ হিসেবে লিখেছেন মাদক ব্যবসায়ী, জুয়াড়ি এবং ক্যাসিনো খেলে।
মুজিবনগর উপজেলার দারিয়াপুরের জ্যোতি তালাকের এফিডেভিটে লিখেছেন তার স্বামী লিজন ক্যাসিনো জুয়াড়ি।
মেহেরপুর সদর উপজেলার বারাদি বাজারের মনিরা খাতুন তার স্বামী মোনায়েম হোসেনকে দেওয়া তালাকনামায় তালাকের কারণ হিসেবে লিখেছেন, তার স্বামী নেশায় আসক্ত এবং জুয়াড়ি। জুয়া খেলার টাকার জন্য যৌতুকের দাবিতে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়।
গাংনী উপজেলার ইসলাম নগরের মোছা. মাছুরা খাতুন বিয়ের ২২ বছর পর তার স্বামী জুগিন্দা গ্রামের হাসান আলিকে তালাক দিয়েছেন। তালাকনামায় তিনি লিখেছেন, তাদের একটি পুত্র সন্তান আছে। তার স্বামী প্রবাসে কর্মরত ছিল। বিদেশ থেকে দেশে এসে সে জুয়া খেলায় জড়িয়ে যায়। এখন আর কোনো কাজকর্ম করে না। জুয়া খেলার টাকা দাবি করে তার স্বামী মাঝেমধ্যেই তাকে মারধর করে।
মুজিবনগরের জেবা তার স্বামী ইমরানকে বিবাহের চার বছর পর তালাক দিয়েছেন। তালাকের কারণ হিসেবে নোটারি পাবলিকের এফিডেভিটে লিখেছেন, তার স্বামী মাদকাসক্ত ও অনলাইন জুয়াড়ি। পাঁচ লাখ টাকা যৌতুক নিয়ে জুয়াতে নষ্ট করেছে। এ ছাড়া তার স্বর্ণালংকার চুরি করে বিক্রি করে সেই টাকাও জুয়াতে নষ্ট করেছেন তার স্বামী।
একাধিক নিকাহ্ রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে তালাকের কারণগুলোর মধ্যে বিস্ময়করভাবে নতুন করে সংযোজন হয়েছে জুয়াড়ি, ক্যাসিনো খেলা এবং অনলাইন জুয়াড়ি। এর বাইরে আগে থেকেই অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও টিকটকের অতিরিক্ত ব্যবহার ও অপব্যবহার। স্ত্রীর পিতা-মাতার স্বামীর পরিবারে বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের প্রবণতা। সঠিকভাবে স্ত্রীর ভরণ পোষণ করতে না পারা এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া।
মেহেরপুর জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ হাজার ২৬টি বিয়ের বিপরীতে তালাক হয়েছে ২ হাজার ১০টি। আার ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলাতে মোট ২ হাজার ১শ বিয়ের পাশাপাশি ১ হাজার ৯২৯টি তালাক রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল। অর্থাৎ বছর ব্যবধানে জেলাতে তালাকের হার বেড়েছে।
মেহেরপুর জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় প্রদত্ত তথ্য মতে, সদর উপজেলায় ৭ জন, মুজিবনগর উপজেলায় ৪ জন এবং গাংনী উপজেলাতে ১১ জন সরকার নিবন্ধিত নিকাহ্ রেজিস্ট্রারের (কাজী) মাধ্যমে বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন করা হয়। এর বাইরে নোটারি পাবলিকের এফিডেভিটের মাধ্যমে যে সব তালাক কার্যকর করা হয়, সেগুলো আদালতের নির্দেশনার পর রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সরকারি নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রার এম এ মাবুদ (নান্নু) কালবেলাকে বলেন, গতবছরের থেকে এ বছরে তালাকের হার বেড়েছে। তবে গত বছর স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক দেওয়ার সংখ্যা বেশি থাকলেও এ বছর স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার সংখ্যা বেশি। আর অধিকাংশ তালাক কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে পরকীয়া সম্পর্ক। তবে বিগত কয়েক মাস ধরে স্ত্রীরা স্বামীকে তালাক দিচ্ছেন জুয়া ও ক্যাসিনো খেলার অভিযোগ এনে। এ বিষয়টা একেবারে নতুন। এর থেকে মেহেরপুর জেলাতে যে অনলাইন জুয়ার একটা মহামারি চলছে সেটা স্পষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশ তথ্য ও মানবাধিকার ফাউন্ডেশন মেহেরপুর জেলা শাখার সভাপতি এবং প্রবীণ সাংবাদিক রফিকুল আলম কালবেলাকে বলেন, মেহেরপুর জেলায় অনলাইন জুয়া একটি সামাজিক ব্যাধি। আর তালাক দেওয়া একটি ট্র্যাডিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে মেয়েরা এখন অনেক সচেতন হয়েছে। তারা আর মাদকাসক্ত, জুয়াড়ি এবং দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে না। দুই মাসে ৬৬ জন নারী তালাকের কারণ হিসেবে অনলাইন জুয়া উল্লেখ করেছেন। আমার মনে হয় এটা হয়তো সম্পূর্ণ সঠিক নয়। তবে সংখ্যাটা একেবারে কমও নয়। ৬৬ তালাকের এক তৃতীয়াংশেরও কারণ যদি অনলাইন জুয়া হয়, সেটাও কম না।