মৎস্য ব্যবস্থাপনায় ৪৭ কোটি টাকার ব্যয়প্রস্তাব নিয়ে ‘প্রশ্ন’

1 hour ago 4

৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মৎস্য ব্যবস্থাপনার একটি প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে মৎস্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে ২২ কোটি টাকা ঠিক কী কারণে চাওয়া হয়েছে তার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পের অন্য ব্যয়প্রস্তাবসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে যৌক্তিক ব্যাখ্যাও চেয়েছে কমিশন।

‘জবই বিল ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বিলসমূহে মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রকল্পে ঘটেছে এমনটি। পরিকল্পনা কমিশন জানায়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ আন্তঃমন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির পরিদর্শন প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে- ‘বিলগুলোর পানির প্রবাহ ও ধারণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিলের তলদেশ এবং সংযোগ খালগুলো খনন প্রয়োজন।’

মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, প্রকল্পের মোট ব্যয় চাওয়া হয়েছে ৪৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। জুলাই ২০২৫ থেকে জুন ২০২৯ সাল নাগাদ মৎস্য অধিদপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। বাস্তবায়ন করা হবে নওগাঁ জেলার সাপাহার, মান্দা, রাজশাহীর তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলায়।

যত বিষয় নিয়ে কমিশনের প্রশ্ন

সংযোগ খালগুলো খননের বিষয়ে পুনর্গঠিত ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। প্রস্তাবিত পুনর্গঠিত ডিপিপিতে মাছের আবাসস্থল উন্নয়ন (খনন-পুনঃখনন) খাতে ২২ কোটি ৮ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। কিন্তু এই অর্থের বিস্তারিত ব্যয় বিভাজন ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত নেই।

প্রকল্পের নানা খাতের প্রস্তাবিত ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম। তারা আমাদের লিখিত আকারে ব্যাখ্যা দিয়েছে। এখন পরবর্তী ধাপে প্রকল্পটি নিয়ে প্রসেস করবো।- বন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উইংয়ের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) ড. অঞ্জন কুমার দেব

পরিদর্শন প্রতিবেদনের সুপারিশে বিলের মাছ যথাসময়ে বাজারজাতকরণে পার্শ্ববর্তী সুবিধাজনক এলাকায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক মাছের আড়ত স্থাপন করতে বলা হয়েছে। প্রকল্পের পুনর্গঠিত ডিপিপিতে আড়ত উন্নয়ন খাতে ৬০ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে, কিন্তু কোন এলাকায় মাছের আড়ত করা হবে তা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে ডিপিপিতে উল্লেখ নেই। অভয়াশ্রম পাহারা ও ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সুফলভোগী মৎস্যজীবীদের সম্পৃক্ত করতে হবে মর্মে উল্লেখ থাকলেও পুনর্গঠিত ডিপিপিতে উক্ত বিষয়ে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে কি না তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই।

পরিকল্পনা কমিশন প্রস্তাবিত প্রকল্পের নানান খাতের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। প্রকল্পে ১৫টি মৎস্য অভয়াশ্রম নির্মাণ খাতে এক কোটি ৫২ লাখ ৫৫ হাজার সংস্থান ছিল। কিন্তু পুনর্গঠিত ডিপিপিতে ১৬টি মৎস্য অভয়াশ্রম নির্মাণ খাতে ব্যয় ৬৬ লাখ টাকা বাড়িয়ে দুই কোটি ১৮ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন বলে জানায় কমিশন। প্রকল্পের ডিপিপিতে হায়ারিং চার্জ খাতে ৮৬ লাখ টাকা, স্টেকহোল্ডার ওয়ার্কশপ/সেমিনার খাতে সাড়ে ৯৪ লাখ টাকা, ব্যবস্থাপনা ব্যয় (সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় সংগঠিতকরণ, প্রকল্প অফিস ও মাঠপর্যায়ের অফিসের জন্য) খাতে ৭৫ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা চেয়েছে কমিশন।

আরও পড়ুন
শুরুতে শেষ ন্যানো প্রযুক্তিতে কৃষি-শিল্প-স্বাস্থ্যে এগোনোর স্বপ্ন
আইসিইউ নির্মাণে ‘ফাঁকি’, ৫৬৪ কোটি টাকার হিসাবে গরমিল
অবহেলিত প্রকল্পের নাম তিস্তা সেচ, শুরুতে দেওয়া হয়নি অর্থ
‘হাবুডুবু’ খাচ্ছে ৩ হাজার কোটি টাকার নৌরুট উন্নয়ন কাজ

প্রকল্পের ডিপিপিতে অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ (মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা/কর্মচারী/সুফলভোগী/এআইজি প্রশিক্ষণ) খাতে এক কোটি ৬৫ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। এই প্রশিক্ষণের গুরুত্ব বিবেচনায় প্রশিক্ষণ সংখ্যা ও ব্যয় প্রাক্কলন যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে। পোনা মাছ অবমুক্তি বিল/প্লাবনভূমিতে দেশীয় প্রজাতি ও রুইজাতীয় মাছের পোনা মজুত খাতে এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা, বিলের বিস্তৃতি চিহ্নিতকরণ ও জিআইএসভিত্তিক রিসোর্স ম্যাপিং খাতে আড়াই কোটি এবং স্পিলওয়েল মেরামত খাতে এক কোটি টাকার যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন বলে জানায় কমিশন।

আমরা প্রকল্পটি নিয়ে কাজ করেছি। যেটা ব্যয় বেশি ধরা হয়েছে তা ঠিক করে দিয়েছি। পরিকল্পনা কমিশনের সব ব্যাখ্যা আমরা মিটআপ করে দিয়েছি। আশা করছি প্রকল্পটি শিগগির পাস হবে।- মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ড. মো. আবদুর রউফ

আয়রন/মেস নেট স্থাপন খাতে এক কোটি, বিল নার্সারি স্থাপন খাতে ৯৩ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে, যা যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে বলে জানায় কমিশন। সামাজিক বনায়নে চার বছরে কত সংখ্যক চারা লাগানো হবে, কত কিমি ও কোন কোন বিলের জায়গায় বনায়ন করা হবে বিস্তারিত উল্লেখ করার কথা থাকলেও তা নেই।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য

প্রকল্প এলাকার বিলগুলোতে সমাজভিত্তিক ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও বিলুপ্ত প্রায় দেশি প্রজাতির মাছ ফিরিয়ে আনতে ইনসিটু ও এক্সসিটু সংরক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণ, বিলের সুফলভোগী জনগোষ্ঠীর দক্ষতা উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন।

মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য সেক্টরের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অনস্বীকার্য। জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান বিবেচনায় নিয়ে মৎস্য সম্পদের স্থায়ীত্বশীল সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা দরকার। দেশের মোট কৃষিজ আয়ের ২২ দশমিক ১৪ শতাংশ আসে মৎস্য উপখাত থেকে, যা দেশের রপ্তানি আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। নওগাঁ জেলার সাপাহার ও মান্দা উপজেলাধীন ‘জবই বিল, বিল মান্দা, বিল উৎরাইল, বিল চককসবা, রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলাধীন কুমারী বিল এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলাধীন বিল সিংগাবাদ পাথার দেশীয় প্রজাতির মাছ, জলজসম্পদ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এলাকায় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি সুফলভোগী জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে।

পরিকল্পনা কমিশনে ‘জবই বিল ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বিলসমূহে মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ মে ২০২৫ তারিখে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগের বন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উইংয়ের অতিরিক্ত সচিবের সভাপতিত্বে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, আইএমইডি এবং মৎস্য অধিদপ্তরের সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্ত মন্ত্রণালয় কমিটি প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেবে।

পরে পাঁচ সদস্যের কমিটি গত ২৯ থেকে ৩০ মে প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেয়। পরিদর্শন প্রতিবেদনে অনুযায়ী কিছু সুপারিশ করা হয়।

সুপারিশগুলো হলো

• বিলের পানির প্রবাহ ও পানির ধারণক্ষমতা বাড়াতে তলদেশ এবং সংযোগ খালগুলো খনন প্রয়োজন। প্রয়োজনে খনন করে মা-মাছসহ দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষায় বিলের গভীরতম অংশে অভয়াশ্রম স্থাপন করা যেতে পারে।
• অভয়াশ্রম পাহারা ও ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সুফলভোগী মৎস্যজীবীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে বিলের বিস্তৃতি চিহ্নিত করতে একটি জিআইএসভিত্তিক ম্যাপিং করা প্রয়োজন।
• মাছের পরিমাণ বাড়াতে বিলের পাশে রেণু উৎপাদন করে তা বর্ষার পানিতে বিলে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিল নার্সারি স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে।
• পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান স্পিলওয়েগুলো মেরামত-সংস্কার করা প্রয়োজন। বিলের মাছ যথাসময়ে বাজারজাতকরণে পাশের সুবিধাজনক এলাকায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক মাছের আড়ত স্থাপন করা যেতে পারে।
• প্রকল্প এলাকায় হিজল, করচ ইত্যাদি গাছ রোপণ করতে হবে। বিলে অবৈধভাবে মৎস্য নিধন ও পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
• দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রাচুর্যতা বাড়ানোর পাশাপাশি দরিদ্র মৎস্যজীবীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে জবই বিলের সমাজভিত্তিক জৈব ব্যবস্থাপনা মডেলটি পার্শ্ববর্তী বিলগুলোতে বিস্তার করা যেতে পারে।

প্রকল্পের মূল কার্যক্রম

• ১০৭টি ব্যাচে মোট দুই হাজার ৬৬০ জন সুফলভোগী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রশিক্ষণ দেওয়া।
• ৬৫টি সেমিনার কর্মশালা, সভা ক্যাম্পেইন ও অভিজ্ঞতা বিনিময় সভার আয়োজন, ১৬টি নো ফিশিং জোন-অভয়াশ্রম এবং ৩১টি বিল নার্সারি স্থাপন, ১৮টি মৎস্য অভয়াশ্রম মেরামত, ৭২ মেট্রিক টন কার্প ও দেশীয় প্রজাতির পোনা মাছ অবমুক্তকরণ।
• ফিশ পাসের জন্য আয়রন/মেস নেট স্থাপন, ৯৬ হেক্টর বিল খনন/পুনঃখনন, জিআইএসভিত্তিক বিলের বিস্তৃতি চিহ্নিতকরণ, সাতটি দেশীয় জলযান কেনা ও বিতরণ।

যা বলছেন দায়িত্বশীলরা

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের বন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উইংয়ের প্রধান (অতিরিক্তি সচিব) ড. অঞ্জন কুমার দেব রায় জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের নানা খাতের প্রস্তাবিত ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম। তারা আমাদের লিখিত আকারে ব্যাখ্যা দিয়েছে। এখন পরবর্তী ধাপে প্রকল্পটি নিয়ে প্রসেস করবো।’

পরিকল্পনা কমিশনের প্রশ্ন প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ড. মো. আবদুর রউফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা প্রকল্পটি নিয়ে কাজ করেছি। যেটা ব্যয় বেশি ধরা হয়েছে তা ঠিক করে দিয়েছি। পরিকল্পনা কমিশনের সব ব্যাখ্যা আমরা মিটআপ করেছি। আশা করছি প্রকল্পটি শিগগির পাস হবে।’

এমওএস/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম

Read Entire Article