সানজানা রহমান যুথী
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার পঙ্ক্তিতে তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী , অর্ধেক তার নর।’ এই পঙ্ক্তি আজও আমাদের সমাজে নারী-পুরুষের সমান অবদানের গুরুত্ব তুলে ধরে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়-এই ‘নারী’ বলতে আমরা কাদের বুঝি? কেবল চাকুরিজীবী, শিক্ষিত, অর্থ উপার্জনে সক্ষম নারীদের? তাহলে যারা গৃহকর্মে নিয়োজিত, যারা পরিবার সামলে রাখেন, সন্তান মানুষ করেন, তাদের অবদান কি তুচ্ছ?
আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে একটি ভুল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। আমরা কেবল অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবদানকে মূল্যায়ন করি। যার ফলে যেসব নারী ঘরে থাকেন, সংসার সামলান তাদের অবদানকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অথচ, প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একজন গৃহিণী যে পরিমাণ কাজ করেন, তা একটি পূর্ণকালীন চাকরির চাইতেও বেশি শ্রমসাধ্য।
গৃহিণীর দৈনন্দিন জীবন: এক অনন্ত কর্মযজ্ঞ
একজন গৃহিণীর দিন শুরু হয় খুব ভোরে। পরিবারের সদস্যদের জন্য নাস্তা প্রস্তুত, সন্তানদের স্কুলে পাঠানো, স্বামীর অফিসের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে দেওয়া সবকিছুতেই তার সরব উপস্থিতি। এরপর আসে ঘর পরিষ্কার, বাজারের তালিকা তৈরি, রান্না করা, কাপড় ধোয়া, অতিথি আপ্যায়ন ইত্যাদি। মাঝেমধ্যে আত্মীয়দের অনুষ্ঠানে উপস্থিতি বা সামাজিক দায়িত্ব পালনও তার ওপর বর্তায়।
শুধু শারীরিক পরিশ্রমই নয়, গৃহিণীদের মানসিক চাপও কম নয়। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের আবেগ, চাহিদা, রুচি, পছন্দ-অপছন্দ সবকিছু মাথায় রেখে প্রতিদিন চলতে হয় তাদের। সন্তানের পড়াশোনা থেকে শুরু করে স্বামীর স্বাস্থ্য, শ্বশুর-শাশুড়ির ওষুধপত্র, এমনকি প্রতিবেশীর কারো সমস্যা সব কিছুতেই তাদের মায়া জড়িয়ে থাকে।
এই শ্রমের বিনিময়ে তারা কোনো বেতন পান না, কোনো ছুটি পান না, নেই অবসরকালীন ভাতা বা স্বীকৃতি। অথচ, পরিবারের সুখ-শান্তির পেছনে তাঁরাই প্রধান কারিগর।
আর্থিক মূল্যায়নের অভাব ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
অনেকেই মনে করেন, যেহেতু গৃহিণী আর্থিকভাবে উপার্জন করেন না, তাই তাদের অবদান ‘গণ্যযোগ্য’ নয়। এই ভাবনা শুধু ভুলই নয়, সমাজের প্রতি অন্যায়ও। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা গেছে, যদি গৃহিণীদের প্রতিদিনের কাজের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়, তাহলে সেটি হতে পারে একজন মাঝারি পেশাজীবীর মাসিক আয়ের চেয়েও বেশি।
তবুও আমাদের সমাজে চাকরি করা নারীকে যতটা সম্মান দেওয়া হয়, গৃহিণীদের প্রতি ততটা দায়িত্বশীল আচরণ করা হয় না। পরিবার তো বটেই, সমাজের চোখেও অনেক সময় তাদের ভূমিকা অবমূল্যায়িত হয়। অথচ তারা যদি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন বা ঘরের কাজ বন্ধ করে দেন, তখনই বোঝা যায় তাদের অবদান কতখানি গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের দিনে অনেক শিক্ষিতা নারীও মা হওয়ার পর কিংবা পারিবারিক চাপের মুখে চাকরি ছেড়ে দেন। তাদের ইচ্ছা থাকলেও দায়িত্বের ভারে তা আর সম্ভব হয় না। এতে সমাজ তাদেরকে ‘অর্থনৈতিকভাবে অক্ষম’ কিংবা ‘গৃহবন্দি’ বলে মনে করে। কিন্তু এসব নারীরাও একসময় স্বপ্ন দেখেছিলেন, ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলেন। তাদের ইচ্ছা, শখ, আল্লাদ সবই ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায় সংসারের দায়িত্বে।
এই নারীদের স্বপ্নকে মূল্য না দিলে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়ে। একজন গৃহিণীও মানুষ, তারও নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার অধিকার রয়েছে। তাই পরিবারের সদস্যদের উচিত, তাকে শুধু গৃহকর্মী হিসেবে না দেখে একজন পূর্ণ মানুষ হিসেবে সম্মান দেওয়া।
গৃহিণী মানেই সমাজের ভিত্তি
যতই চাকরিজীবী হোন বা ব্যবসায়ী, একজন মানুষ যখন বাসায় ফেরেন, তখন তিনি শান্তি চান, ভালোবাসা চান, নিজের মানুষদের পাশে পেতে চান। এই শান্তির জায়গাটি নিশ্চিত করেন যিনি, তিনিই গৃহিণী। তার স্নেহ-মমতা, যত্ন, বোঝাপড়া সব মিলিয়ে পরিবার হয় একটি নিরাপদ আশ্রয়।
একজন গৃহিণী শুধু ঘরের কাজই করেন না; তিনি সন্তানকে মূল্যবোধ শেখান, আত্মীয়দের সম্পর্ক ধরে রাখেন, সমাজে সংস্কৃতির চর্চা করেন, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান পরিচালনায় যুক্ত থাকেন। এসব কার্যক্রমে তার অংশগ্রহণ না থাকলে পরিবারে যেমন শৃঙ্খলা থাকত না, তেমনি সমাজেও নেমে আসত বিশৃঙ্খলা।
তাই সময় এসেছে এই প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ভাঙার। গৃহিণীর কাজকে ছোট করে দেখা নয়, বরং সেটিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এখন। তাদের অবদানকে সম্মান করতে হবে পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে, তাদের জন্য বিশ্রামের সুযোগ তৈরি করে, মাঝে মাঝে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
আমরা যদি সত্যি উন্নত সমাজ গড়তে চাই, তাহলে নারীর প্রতিটি ভূমিকার মূল্যায়ন করতে হবে সে ঘরের হোক কিংবা ঘরের বাইরের। পরিবারে একজন গৃহিণীর অবদান কখনোই শুধু সংসারেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা ছড়িয়ে পড়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, সমাজ থেকে সমাজে।
কেএসকে/জিকেএস