আগামীতে যারা ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরাচার হওয়ার কথা ভাবছেন আজকের দিনটি তাদের জন্য শিক্ষণীয় বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম। জুলাই-আগস্টের গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা মামলার আসামি শেখ হাসিনার গ্রেফতারের অগ্রগতি ও মন্ত্রী-সচিবসহ ১৩ জনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গ্রেফতার দেখানোর পর তিনি এমন কথা বলেন।
তাজুল ইসলাম জানান, বিগত সরকারের যারা ক্ষমতাসীন ছিলেন, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ছিলেন, উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন, সচিব ছিলেন এমন ১৩ জনকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। আগামী দিনের যারা ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরাচার হওয়ার কথা ভাবছেন আজকের দিনটি তাদের জন্য একটা শিক্ষার দিন।
ক্ষমতার দম্ভে গণহত্যা করে এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ করে চিরদিন থাকা যায় না, বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। আজকের দিনে আদালতের এ দৃশ্য দেখে ভবিষ্যতে যারা বাংলাদেশে স্বৈরাচারী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তাদের জন্য আজকের দিনটি একটা শিক্ষা গ্রহণের দিন।
বিগত সরকারের ১৩ জন ক্ষমতাশালী ব্যক্তিকে হাজির করা হয়েছিল। যাদের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা এবং অন্যান্য যেগুলো আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ সেগুলোর দায়ে তাদের উপস্থিত করা হয়েছিল।
এ অপরাধের পেছনে যে পটভূমি আছে আজ আদালতে তার ব্যাখ্যা করেছি। ২০০৯ সাল থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিকরণ, দলীয়করণ এবং পারিবারিকীকরণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক দেশকে একটা ফ্যাসিবাদী ও নিপীড়ক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছিল সেই পটভূমি তুলে করেছি।
আমরা বলেছি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিবাদী জনতাকে স্তব্ধ করা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মাধ্যমে মানুষের বাকস্বাধীনতা, অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে ভয়েস সেটাকে রুদ্ধ করা হয়। একের পর এক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি এবং তার পরিবারকে ক্ষমতায় রাখার উদ্দেশ্যে এগুলো করা হয়। একটা রাষ্ট্রের চেতনার বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নিয়েছিল।
এসবের প্রধান আসামি হচ্ছেন শেখ হাসিনা। শুধুমাত্র তাকে রক্ষা করতে গিয়ে এসব করা হয়। সমস্ত অপরাধের সবচেয়ে বড় দায় হচ্ছে শেখ হাসিনার। তার নির্দেশে তাকে ক্ষমতা রাখার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য যে ১৩ জনকে উপস্থিত করা হয়েছিল তারা মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হিসেবে, সরকার দলের বিভিন্ন পদে অধৃষ্ট থেকে, আমলাতন্ত্রের মধ্যে থেকে, সংসদ সদস্য এবং ১৪ দলের নেতা সবাই মিলে এসব নৃশংসভাবে অপরাধ করেছেন।
দেড় হাজারের অধিক ছাত্র-তরুণ-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে আহত করেছেন। গোটা বাংলাদেশজুড়ে নৃশংসতা চালানো হয়েছে, সাধারণ মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর মরদেহ দাফনে বাধা দেওয়া হয়, মরদেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়, আহতদের চিকিৎসা দিতে বাধা হয়েছে। টার্গেট করে সেগুলো করা হয়েছে। আমরা বলেছি-একটা তদন্ত করে বিচারের উপযোগী একটা রিপোর্ট দাখিলের জন্য একটা যুক্তিসংগত সময় চেয়েছিলাম। আমরা ২ মাস সময় চেয়েছিলাম, আদালত ১ মাস সময় মঞ্জুর করেছেন। সেদিন রিপোর্ট দাখিলের জন্য রাখা হয়েছে। সেদিন আসামিদের নিয়ে আসা হবে।
আমরা আশা করছি দ্রুতই তদন্ত সংস্থার কাছ থেকে এ রিপোর্ট পেয়ে যাব। এরপরই মামলাটি আনুষ্ঠানিক বিচারের যাত্রা শুরু করবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধ যে শুধু জুলাই-আগস্টে হয়েছে তা কিন্তু নয়। এই বিগত সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গুম, খুন এবং আয়না ঘরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে, তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে এসব তথ্য-উপাত্ত পাচ্ছি। গুম কমিশনের কাছ থেকেও জানা যাচ্ছে। নির্যাতন ক্যাম্পগুলোকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হতো, সেই ক্যাম্পগুলোতে যে পদ্ধতিতে নির্যাতন করা হয়েছে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনীর যে ক্যাম্পগুলো ছিল সেই ধরনের নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তুলনীয়। অপহরণ, গোপন কারাগারে আটক এবং টর্চার সেলে রেখে মানুষদের নির্যাতন চালানো হয়।
তদন্ত সংস্থা যে রিপোর্ট দিয়েছে একটিতে শেখ হাসিনা একমাত্র আসামি, তার ব্যাপারে রিপোর্ট এসেছে তিনি দেশের বাইরে পালিয়ে ভারতে অবস্থান করেছেন। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্টারপোলের কাছে রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছি। তাকে পেলে যেন গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে সরকার বলেছে, ভারতের সঙ্গে যে বহিঃসমর্পণ চুক্তি সেটার মূলে চিন্তা করছেন বলে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন। এটাও আমরা আদালতকে জানিয়েছি।
তিনি বলেন, যে ১৩ জনকে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মোটাদাগে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির দায়ে অভিযুক্ত। কারণ তারা নির্দেশ দিয়েছেন, পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, সরাসরিও জড়িত ছিল। স্বরাষ্ট্র সচিব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তারা সরাসরি সম্পৃক্ত আছেন। আন্তর্জাতিক আইনে প্ররোচনা দেওয়া, পরিকল্পনার সঙ্গে থাকা, যারা সরাসরি অংশ নিয়েছে তাদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও শাস্তি না দেওয়া এগুলো অপরাধ। এ অপরাধের দায় প্রত্যেক আসামির ওপর আছে।
এক আইনজীবী একটি আবেদন যথাযথ নিয়মে আবেদন করেনি। অন্যান্য আসামির পক্ষে কয়েকজন আইনজীবী ওকালতনামা দাখিল করেছে কিন্তু বক্তব্য রাখেননি। আসামিদের সঙ্গে কথা বলার জন্য তারা অনুরোধ জানিয়েছিল। আদালত বলেছেন শৃঙ্খলা রক্ষা করে রেজিস্ট্রারের তত্ত্বাবধানে যেন তারা কথা বলে।
এফএইচ/এমআইএইচএস/জেআইএম