সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।
বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সব কথা ও কাজ ছিল শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রত্যেকটি শিক্ষাকে তিনি নিজে প্রথমে বাস্তবায়ন করেছেন, তারপর সেই শিক্ষা অন্যদেরকে আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন।
সব ধর্মীয় মতবিরোধ সত্ত্বেও আল্লাহ ‘রাব্বুল আলামিন’ জগৎসমূহের একমাত্র প্রতিপালক হিসাবে সবাইকে সমভাবে লালনপালন করে থাকেন। আস্তিক-নাস্তিক, মুসলমান-অমুসলমান সবার শেষ ঠাঁই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সৃষ্ট এ মাটিতেই হয়।
বিশ্বাসের বিরোধ থাকা সত্ত্বে সবাইকে একই মেঘের পানি দিয়ে তিনি সিঞ্চিত করেন। আস্তিক-নাস্তিক সবাইকে তার সৃষ্ট সূর্য নিজের রোদ সমভাবে প্রদান করে। এই একই কাদামাটিতে সবাই চাষাবাদ করে সমানভাবে উপকৃত হয়।
মহান আল্লাহর দয়া ও কৃপার এই সার্বজনীনতা মানুষকে, বিশেষ করে মুসলমানদেরকে শিক্ষা দিচ্ছে, আমরাও যেন আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়ে সবার জন্য উদারতা প্রদর্শন করি।
বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষকে সম্মান দিয়েছেন। ইসলামের ঘোরতর শত্রু ও কাফেরের লাশকেও তিনি সম্মান প্রদর্শন করেছেন এবং তার উম্মতকেও তা করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
হাদিস শরিফে জানা যায় যে, একবার হজরত সাহল ইবনে হুনাইফ রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হজরত কায়স ইবনে সাদ আনহু কাদিসিয়াতে বসা ছিলেন, তখন লোকেরা তাদের সামনে দিয়ে একটি জানাজা নিয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে তারা দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তাদের বলা হল, এটা এ দেশীয় অমুসলিম জিম্মি ব্যক্তির জানাজা।
তখন এই সাহাবি রাদিয়াল্লাহু আনহুগণ বললেন, ‘একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে দিয়েও একটি জানাজা যাচ্ছিল। তখন তিনি দাঁড়িয়ে গেলে তাকে বলা হয়েছিল, এটা তো এক ইহুদির জানাজা। তিনি এরশাদ করেছিলেন, সে কি একজন মানুষ নয়?’ (বুখারি কিতাবুল জানায়েয, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনূদিত, হাদিস নম্বর ১২৩৪)
হজরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু মৃত ব্যক্তির সম্মান প্রদর্শনই করেননি বরং মৃতদের গালমন্দ, লাশের অসম্মান, তাদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করাকে গোনাহর কাজ বলে উল্লেখ করেছেন। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা মৃতদের গালমন্দ করো না, তারা যা করেছে তারা তা পেয়েছে।’ (বুখারি)
তাই সাধারণ কোন লাশ তো দূরের কথা এক ঘোরতর শত্রু কাফের-ইহুদির লাশের প্রতিও আমাদের প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্মান প্রদর্শন করেছেন। শুধু তা-ই নয় তার দীক্ষায় দীক্ষিত নক্ষত্রতুল্য সাহাবিরাও একই আচরণ করে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন।
হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবজাতক ফিতরতের ওপর জন্মগ্রহণ করে। এরপর তার মাতাপিতা তাকে ইহুদি বা খ্রিষ্টান অথবা অগ্নি-উপাসকরূপে রূপান্তরিত করে।’ (সহিহ বুখারি, কিতাবুল জানায়েয, দ্বিতীয় খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনূদিত, হাদিস নম্বর-১৩০২)।
জন্মিলে মরিতে হয় এটি একটি চিরসত্য কথা। এই পৃথিবীতে কেউ স্থায়ী নয়। প্রকৃতিতে প্রত্যেক প্রাণীর জন্য মৃত্যুর চাইতে সুনিশ্চিত বিষয় আর কিছুই নেই। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- 'আপনার আগেও কোনো মানুষকে আমি অনন্ত জীবন দান করিনি। সুতরাং আপনার মৃত্যু হলে তারা কি চিরঞ্জীব হবে? প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।' (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৩৪-৩৫)
আল্লাহপাক আরো ইরশাদ করেছেন ‘প্রত্যেক প্রাণীকে আস্বাদন করতে হবে মৃত্যু। আর তোমরা কেয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোজখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, তার কার্যসিদ্ধি ঘটবে। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোনো সম্পদ নয়।' (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৮৫)
প্রত্যেক আত্মাকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে অথচ মানুষ এ মৃত্যুর কথা একেবারেই ভুলে থাকে। মৃত্যুর কথা একবারও স্মরণ করে না। আমরা যেখানেই থাকি না কেন আমাদেরকে মৃত্যু বরণ করতেই হবে।
যেভাবে আল্লাহতায়ালা আরো ইরশাদ করেন-'তোমরা যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দুর্গের ভেতরেও অবস্থান কর, তবুও।’ (সুরা আন-নিসা : আয়াত ৭৮)
প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে মৃত্যু যে একটি অবশ্যম্ভাবী সত্য তা এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। এ পৃথিবী অত্যন্ত মধুময় ও আকর্ষণীয় বলে মনে হয় কিন্তু আসলেই তা ছলনায় পরিপূর্ণ। অল্প ক’দিনের এ দুনিয়ায় আমরা মেহমান মাত্র। তাই আমাদের উচিত হবে মৃত্যুর কথা স্মরণ করে বেশি বেশি পুণ্যের কাজ করা।
হজরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু মৃত ব্যক্তির সম্মান প্রদর্শনই করেননি বরং মৃতদের গালমন্দ, লাশের অসম্মান, তাদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করাকে গোনাহর কাজ বলে উল্লেখ করেছেন।
হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা মৃতদের গালমন্দ করো না, তারা যা করেছে তারা তা পেয়েছে।’ (বুখারি)
মৃত ব্যক্তির ভালো কাজকে স্মরণ করা মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা তোমাদের মৃতদের ভালো কাজগুলোর আলোচনা করো এবং মন্দ কাজের আলোচনা থেকে বিরত থাকো।’ (আবু দাউদ)
বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবির উম্মত হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অতুলনীয় জীবনাদর্শ অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করা। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের দ্বারা এমন কোন কাজ যেন সংঘটিত না হয় যার ফলে ইসলাম এবং শ্রেষ্ঠনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ পরিপন্থি সাব্যস্ত হয়।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে হজরত রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অতুলনীয় জীবনাদর্শ হৃদয়ে ধারণ করার এবং তা নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
[email protected]
এইচআর/এমএস