যে কারণে সৃষ্টিকর্তার কল্যাণ থেকে আমরা দূরে

3 hours ago 4

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে কেবল শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে আখ্যায়িত করেননি বরং যথাযথ মর্যাদায় সম্মানিতও করেছেন। সেই সাথে আমাদেরকে তিনি বিনা কারণে বা দুনিয়াবী আনন্দ ফুর্তির জন্য পাঠাননি। আমাদেরকে যে উদ্দেশ্যে তিনি সৃষ্টি করেছেন তা ভুলে গিয়ে আজ আমরা বাহ্যিক দুনিয়ার আনন্দ ফুর্তিতেই ডুবে আছি।

এমন কোন পাপকর্ম আছে যা আজ আমাদের দ্বারা হচ্ছে না, চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণসহ যত প্রকারের অন্যায় আছে সবই হচ্ছে। সামান্য সামান্য অপরাধে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে হত্যা করতেও দ্বিধা করছি না। আল্লাহতায়ালা কি আমাদেরকে এ জন্যই সৃষ্টি করেছেন যে, তোমরা যা ইচ্ছে তা করে বেড়াও? না, মোটেও না, আমাদেরকে তিনি অহেতুক সৃষ্টি করেন নি।

যেভাবে আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন: ‘মানুষ কি মনে করে, তাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ছেড়ে দেয়া হবে? (সুরা কিয়ামা, আয়াত: ৩৬)
আবার সুরা মুমিনুনের ১১৫ নম্বর আয়াতে মহান স্রষ্টা এ কথাই ব্যক্ত করেছেন ‘তোমরা কি ভেবেছো তোমাদের অহেতুক সৃষ্টি করেছি।’

আজ যদি আমরা পরের দুঃখে ব্যথিত হই, অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করি তাহলে সেই সত্তা যিনি আমাদের জীবনশিরারও নিকটে অবস্থান করেন তিনিই আমাদের সব সমস্যা দূর করবেন। আজ যদি আমরা আমাদের জন্মের উদ্দেশ্যকে বুঝতে পারতাম তাহলে অবশ্যই পশুর ন্যায় ছুটে বেড়াতাম না আর মানুষকে কষ্ট না দিয়ে তার মঙ্গল কামনা করতাম। আমরা যদি সমাজ ও দেশের শান্তিপ্রিয় নাগরিক হতাম তাহলে হয়তো তিনি আমাদের ক্ষমা করে তার নিরাপত্তার চাদরে জড়িয়ে নিতেন।

মোটেও নয় বরং বিশেষ উদ্দেশ্যের জন্যই আমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যেহেতু আজ আমরা আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য ভুলে বসেছি, তাইতো সমাজ, দেশ ও বিশ্বের সর্বত্র অশান্তি বিরাজমান। আমার অধিকার, আমার প্রাপ্য, আমর সম্মান সব কিছু সম্পর্কেই আমি খুব ভালো বুঝি, অন্যের উপকারের কথা আসলেই কেবল আমি বুঝি না।
একের পর এক অন্যায় আমার দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে, ক্ষণিকের জন্যও আমি আমার প্রভুকে স্মরণ করি না, তাকে ভয় করি না। অথচ তিনি আমাদের সাথেই আছেন, আমাদের অপকর্ম দেখা সত্ত্বেও আমাদেরকে ছাড় দিচ্ছেন, সংশোধনের সময় দিচ্ছেন।

এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন: ‘যেখানেই তোমরা যাও তিনি তোমাদের সাথে থাকেন আর তোমরা যা-ই কর আল্লাহ তা পুরোপুরি দেখেন।’ (সুরা হাদিদ, আয়াত: ৪)

পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক এটাও বলেছেন, ‘তিনি আমাদের জীবনশিরা অপেক্ষাও নিকটে রয়েছেন।’ (সুরা কাফ, আয়াত: ১৬)

আল্লাহপাক আমাদের এত নিকটে তারপরও আমরা তার রহমত থেকে বঞ্চিত থেকে যাই। এর কারণ হলো- আমার যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, সব কিছুই যে তার, আমার যে কিছুই নাই, এই বিষয়টা নিয়ে কখনও আমি চিন্তা করি না। আর এ কারণেই আমি আমার সৃষ্টিকর্তা প্রভুকেও চিন্তে পারছি না এবং তার কল্যাণ থেকে বহু দূরে অবস্থান করছি।

হাদিসে এসেছে, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার নিজ সত্তার পরিচিতি লাভ করতে পেরেছে সে মহান প্রভুকে চিন্তে পেরেছে।’

উল্লিখিত হাদিসের কথাই পবিত্র কুরআনে সুরা হাশরের ১৯ নম্বর আয়াতে ভিন্ন ভঙ্গিতে মহান স্রষ্টা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন।’

এ কথার অর্থ হল আল্লাহকে ভুলে যাওয়া সমান নিজ সত্তাকে ভুলে যাওয়া। আসলেই কি মানুষ তার নিজ সত্তাকে ভুলে যায়? হ্যাঁ, মানুষ নিজ সত্তাকে ভুলে যায়। আজ আমরা নিজ সত্তাকে ভুলে বসেছি। যেহেতু আজ আমরা নিজ সত্তাকে ভুলে বসেছি তাই আজ আমার দ্বারা কেউ আর নিরাপদ নয়।

নিরীহ ও নিষ্পাপ শিশুদের ওপর জুলুম অত্যাচার করতেও আজ মানুষের হৃদয় কাঁদে না। অহংকার আর ক্ষমতার দাপটে মানুষ তার জন্মের উদ্দেশ্যকে ভুলে বসেছে। অথচ আমরা দেখতে পাই ইবলিসের সমস্ত আমল নষ্ট হয়েছিল কেবল তার অহংকার আর আমিত্বের কারণেই। সে নিজের সৃষ্টির উপাদানকে শ্রেষ্ঠ মনে করে আদমের সৃষ্টিগত উপাদানকে (মাটি) তুচ্ছজ্ঞান করে প্রভুর নির্দেশের অবাধ্য হয়। ফলে তার অর্জিত সকল আমল বিনষ্ট হয়ে যায় এবং সে প্রভুর অভিশাপে পতিত হয়।

তাই মানুষ যাতে কখনো অহংকারী না হয় এবং আমিত্ব তাকে গ্রাস না করে সেজন্যই মহান প্রতিপালক তাকে তার সৃষ্টিগত উপাদানের কথা পবিত্র কুরআনে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

আজ যারা ক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তির গর্ব করে আল্লাহপাকের সৃষ্টিকে কষ্ট দেয় তাদের অবস্থা যে ইবলিসের ন্যায় হবে না তা কি আমরা কখনও ভেবে দেখেছি?

আজ আমরা সৃষ্টিকর্তা এক অদ্বিতীয় আল্লাহকে ভুলে গিয়ে হৃদয়ে শত শত মিথ্যা খোদার স্থান দিয়েছি। মুখে এক আর অন্তরে ভিন্ন, এটাই যেন আজ রীতিতে পরিণত হয়েছে। অথচ আমাদের অন্তরে কী আছে তা তিনি খুব ভালো করেই জানেন।

তাই মানুষকে নানান ভাবে ধোঁকা দেয়া সম্ভব কিন্তু আল্লাহপাককে ধোঁকা দেয়া সম্ভব নয়, কারণ তিনি প্রকাশ্য এবং গোপন, ভিতর এবং বাহিরের সব কিছু সম্পর্কেই অবগত।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘তুমি বল, তোমাদের অন্তরে যা আছে তা তোমরা গোপন কর বা তা প্রকাশ কর আল্লাহ তা জানেন। আর আকাশসমূহে যা আছে এবং পৃথিবীতে যা আছে তিনি তাও জানেন। আর আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে সর্বশক্তিমান। সেদিন প্রত্যেকেই যা কিছু সে ভাল কাজ করেছে, চোখের সামনে দেখতে পাবে এবং যা কিছু মন্দ কাজ করেছে তাও, ওরা তখন কামনা করবে, যদি তার এবং এসব কর্মের মধ্যে ব্যবধান দীর্ঘ হতো! আল্লাহ তার নিজের সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করছেন। আর আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি অতি মমতাশীল।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ২৯-৩০)

এখন সময় এসেছে নিজেকে চেনার ও জানার, নিজেকে সংশোধন করার। অনেকে বলতে পারেন, কেবল নিজেকে চিনলে লাভ কি? হ্যাঁ, লাভ আছে। যেভাবে বিন্দু বিন্দু জল মিলে নদী হয়, ছোট ছোট পাথর মিলে পাহাড় হয়, লতাপাতা, ছোট ছোট গাছ মিলে জঙ্গল হয় এভাবেই এক এক ব্যক্তি মিলে জাতি গঠিত হয়।

কোন জাতির গঠন, উন্নতি, শ্রেষ্ঠত্ব ও দৃঢ়তা অর্জনে ঐ জাতির ব্যক্তিরাই মেরুদণ্ডের হাড়ের ভূমিকা রাখে। এই সত্যকে অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই যে, কোন জাতির উন্নতির শিখরে পৌঁছার ক্ষেত্রে সেই জাতির লোকেরা চাবিকাঠির ভূমিকা রাখে। সেখানে এ বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য, কোন জাতির অধঃপতনের চরমে নিপতিত হওয়ার ক্ষেত্রেও তারাই দায়ী।

আজ যদি আমরা পরের দুঃখে ব্যথিত হই, অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করি তাহলে সেই সত্তা যিনি আমাদের জীবনশিরারও নিকটে অবস্থান করেন তিনিই আমাদের সব সমস্যা দূর করবেন। আজ যদি আমরা আমাদের জন্মের উদ্দেশ্যকে বুঝতে পারতাম তাহলে অবশ্যই পশুর ন্যায় ছুটে বেড়াতাম না আর মানুষকে কষ্ট না দিয়ে তার মঙ্গল কামনা করতাম। আমরা যদি সমাজ ও দেশের শান্তিপ্রিয় নাগরিক হতাম তাহলে হয়তো তিনি আমাদের ক্ষমা করে তার নিরাপত্তার চাদরে জড়িয়ে নিতেন।

আল্লাহপাক আমাদেরকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
[email protected]

এইচআর/জিকেএস

Read Entire Article