বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পরপর তিন দিন (গত বুধ-শুক্রবার) প্রকাশ্যে ঘটেছে খুন ও অস্ত্রবাজির ঘটনা। চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপি মনোনীত এমপিপ্রার্থী এরশাদ উল্লাহসহ গুলিবিদ্ধ হন বেশ কয়েকজন। একজন নিহত হন। সবশেষ রাজধানীর পুরান ঢাকায় দিনে-দুপুরে গুলি করে হত্যা করা হলো তারিক সাইফ মামুন (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে।
এর আগে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার চরাঞ্চলে বিএনপির দুই পক্ষের বিরোধের জেরে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘটছে অস্ত্রবাজি ও গুলির ঘটনা।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বাড়ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সক্রিয় হচ্ছে দুর্বৃত্তরা। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে একের পর এক গোলাগুলির ঘটনায় বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ১৩ নভেম্বর ঢাকা লকডাউন কর্মর্সূচি ঘোষণা করায় তৈরি হয়েছে আরেক ধরনের অস্থিরতা। গত দুদিনে রাজধানীতে বেশ কয়েকটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান লক্ষ্য করে।
লুট হওয়া অস্ত্র আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। এসব অস্ত্র পড়ে থাকে না, একাধিক হাত ইতোমধ্যে বদল হয়েছে। সন্ত্রাসীদের কাছে এতদিন পৌঁছে গেছে। এখনো সময় আছে, এসব অস্ত্র উদ্ধার করা জরুরি।- পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানি থামানো না গেলে নির্বাচনের আগে আরও বাড়তে পারে, যা ভোটে প্রভাব ফেলবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এখনই কঠোর হওয়া দরকার।
পুলিশ বলছে, আগের তুলনায় অপরাধ কিছুটা কমেছে। তবে হরহামেশাই আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে। ৫ আগস্টের পর পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র, জমা না দেওয়া অস্ত্র এবং অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান।

সম্প্রতি সরকার ঘোষণা করেছে, পুলিশের লুট হওয়া এলএমজি উদ্ধারে মিলবে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার। এছাড়া এসএমজি উদ্ধারে দেড় লাখ টাকা, চায়না রাইফেল এক লাখ টাকা এবং পিস্তল ও শটগান উদ্ধারে পাওয়া যাবে ৫০ হাজার টাকা। প্রতি রাউন্ড গুলির জন্য পুরস্কার রয়েছে পাঁচশ টাকা।
তবে পুলিশের একটি সূত্র বলছে, একবার আগ্নেয়াস্ত্র হাতছাড়া হলে তা উদ্ধার করা কঠিন। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র কেনাবেচা করে। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের বিষয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে গোয়েন্দা বাহিনীও তৎপর।
আরও পড়ুন
২৯ বছর আগের হত্যা মামলার হাজিরা দিতে এসেই খুন হলেন মামুন
চট্টগ্রামে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী গণসংযোগকালে গুলিবিদ্ধ
হেলিকপ্টারে ঢাকা নেওয়া হলো গুলিবিদ্ধ বিএনপির প্রার্থী এরশাদকে
‘লাগামহীন’ আগ্নেয়াস্ত্র, কথায় কথায় গুলি
গত বছর ৫ আগস্টের পর পুলিশের লুণ্ঠিত বিপুল সংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ এখনো উদ্ধার হয়নি। সবশেষ হিসাব বলছে, এখনো এক হাজার ৩৪২টি আগ্নেয়াস্ত্র ও দুই লাখ ৫৭ হাজার ২৮৭ রাউন্ড গোলাবারুদ বেহাত অবস্থায় রয়েছে।
অবৈধ অস্ত্রের বিষয়ে পুলিশের জিরো টলারেন্স। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ৪৪২১টি। আরও কিছু অস্ত্র রয়েছে, যা উদ্ধারে পুলিশ কাজ করছে।- পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এসব অস্ত্র ব্যবহার করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, গত বছর ৫ আগস্টের পর দেশের ৬৬৪টি থানার মধ্যে ৪৬০ থানা ও ১১৪টি ফাঁড়িতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করে লুটপাট করা হয় ৫ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র। এছাড়া ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮টি গোলাবারুদ নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
পুলিশের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, লুট হওয়া ১ হাজার ১১৪টি চায়না রাইফেলের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ১০০০টি। আরেকটি মডেলের ১২টি রাইফেলের মধ্যে ১১টি উদ্ধার হলেও একটি উদ্ধার হয়নি। এসএমজি-(টি ৫৬) ২৫৩টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ২২২টি। এলএমজি (টি-৫৬) ৩৪টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩১টি। পিস্তল (টি-৫৪) ৫৩৯টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩২৫টি। ৯ ইনটু ১৯ মিমি ১ হাজার ৯২টি পিস্তলের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৬৩৭টি। এখনো উদ্ধার হয়নি ৪৫৫টি পিস্তল। ৯ ইনটু ১৯ এসএমজি/এসএমটি ৩৩টির মধ্যে সবকটি উদ্ধার হয়েছে। ১২ বোরের শটগান ২ হাজার ৭৯টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ১৬৮৬টি। ৩৮ মিমি গ্যাসগান ৫৮৯টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৪৬০টি। ৩৮ মিমি টিয়ারগ্যাস লাঞ্চার ১৫টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৮টি। এখনো উদ্ধার হয়নি ৭টি। ২৬ মিমি পিস্তল ৩টির মধ্যে একটি উদ্ধার হয়েছে।

গোলাবারুদের মধ্যে- বিভিন্ন বোরের ৬ লাখ ১৩ হাজার ১৫৮টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ১৮৪টি। এখনো উদ্ধার হয়নি ২ লাখ ৪৩ হাজার ৯৭৪টি। বিভিন্ন ধরনের টিয়ারগ্যাস সেলের ৩১ হাজার ২১২টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ১৯ হাজার ৮২১টি, টিয়ারগ্যাস গ্রেনেড ১ হাজার ৪৮৬টির মধ্যে ১ হাজার ১৯৫টি, সাউন্ড গ্রেনেড ৪ হাজার ৭৪৬টির মধ্যে ৩ হাজার ৫৭৮টি, কালার স্মোক গ্রেনেড ২৭৩টির মধ্যে ২৩২টি, সেভেন মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড ৫৫টির মধ্যে ৩৩টি, ফ্ল্যাশ ব্যাং/৬ গ্রেনেড ৯০০টির মধ্যে ৬১৬টি ও হ্যান্ড হেল্ড টিয়ারগ্যাস স্প্রে ১৭৮টির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে মাত্র ৬২টি।
অপরাধীদের হাতে লুট হওয়া অস্ত্র
ঢাকা ও চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক কয়েকটি খুন-বড় ছিনতাইয়ের ঘটনায় লুট হওয়া অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। অস্ত্র কার হাতে গেছে, কোথায় পাচার হচ্ছে—এসব তথ্য জানার পরও যথাযথ অভিযান চালানো হয়নি বলে অভিযোগ। এতে অপরাধীদের মনোবল বেড়েছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতাও বাড়ছে।
নির্বাচন ঘিরে বাড়ে অস্ত্রের চাহিদা
প্রতিটি নির্বাচন ঘিরে অবৈধ অস্ত্রের চাহিদা বাড়ে। স্থানীয় পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তার, ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানোর কাজে অস্ত্রের ব্যবহার নতুন নয়। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, এবারও নির্বাচনের আগে নতুন করে ‘অস্ত্রের বাজার’ সচল হওয়ার আভাস মিলছে। এর সঙ্গে লুট হওয়া অস্ত্র মিশে গেলে সহিংসতার ঝুঁকি বহুগুণে বাড়বে।
নির্বাচনের আগেই জনসংযোগে অস্ত্র প্রদর্শন-গুলি
সোমবার (১০ নভেম্বর) প্রায় ২৯ বছর আগের একটি হত্যা মামলায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এ হাজিরা দিতে আসেন তারিক সাইফ মামুন (৫৫)। ফেরার পথে বেলা ১১টার দিকে আদালতপাড়ার কাছে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে খুন হয়েছেন তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, হাসপাতালের প্রবেশমুখে হঠাৎ দুই দুর্বৃত্ত তার পেছনে এসে খুব কাছ থেকে একাধিক গুলি চালান। গুলি লেগে ঘটনাস্থলেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর হামলাকারীরা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
বিষয়গুলো রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে সম্পর্কিত। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোন্দল, সংঘাত রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে রাজনৈতিক অস্থিরতাটাই মূল উদ্বেগের বিষয়।- অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ওমর ফারুক
চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিতাতলীর খন্দকারপাড়া এলাকায় গত ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় জনসংযোগ চলছিল চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর। হঠাৎ গুলির শব্দ। ছত্রভঙ্গ হয়ে যান নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় এরশাদ উল্লাহসহ পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। তাদের মধ্যে মারা যান বহরে থাকা সরোয়ার বাবলা। পরে পুলিশ জানায়, সরোয়ারের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, অস্ত্র, হত্যাসহ ১৫টি মামলা রয়েছে।
পরদিন বৃহস্পতিবার একই এলাকায় ইদ্রিস আলী নামে একজনকে গুলি করা হয়। তিনি সন্ত্রাসী ইসমাইল হোসেনের ভাই। তার বিরুদ্ধেও মামলা রয়েছে।
ওই দুই ঘটনা নিয়ে যখন নগরজুড়ে মাতামাতি, তখন ৭ নভেম্বর নগরের হালিশহর মাইজপাড়া এলাকায় মো. আকবর নামে এক ব্যক্তিকে রাস্তায় প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। তার বিরুদ্ধে থানায় মাদকের মামলা রয়েছে।
যা বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও বিশেষজ্ঞরা
চট্টগ্রামের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাউজানে মোট ছয় দল সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে পুলিশ তাদের সহযোগীদের গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধার করেছে। পুলিশ-সন্ত্রাসী একসঙ্গে থাকতে পারে না। হয় পুলিশ থাকবে, না হয় সন্ত্রাসী থাকবে। অস্ত্র উদ্ধার ও আসামি গ্রেফতারে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ তৎপরতা চালাচ্ছে।’
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা জাগো নিউজকে বলেন, ‘লুট হওয়া অস্ত্র আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। এসব অস্ত্র পড়ে থাকে না, একাধিক হাত ইতোমধ্যে বদল হয়েছে। সন্ত্রাসীদের কাছে এতদিন পৌঁছে গেছে। এখনো সময় আছে, এসব অস্ত্র উদ্ধার করা জরুরি।’
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্রের বিষয়ে পুলিশের জিরো টলারেন্স। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ৪৪২১টি। আরও কিছু অস্ত্র রয়েছে, যা উদ্ধারে পুলিশ কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সারাদেশে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান জোরদার করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়গুলো রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে সম্পর্কিত। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোন্দল, সংঘাত রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে রাজনৈতিক অস্থিরতাটাই মূল উদ্বেগের বিষয়। এ কারণেই গোলাগুলি বা হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটছে।’
তিনি বলেন, ‘যত দিন যাচ্ছে অস্থিরতা ততই বাড়বে। কমানোর জন্য রাষ্ট্রীয় অথবা সরকারের উদ্যোগ সেভাবে নেই। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে নৈরাজ্য, নাশকতা ও হত্যাকাণ্ড সুযোগ হিসেবে বেছে নিচ্ছে এক পক্ষ। অন্যদিকে, পেশাদারত্বের জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এখনো ঘাটতি রয়েছে।’
টিটি/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম

1 hour ago
4









English (US) ·