লালন শাহ: সময়ের আয়নায় আশ্চর্য দীপ্তি

21 hours ago 6

মো. রাহুল শেখ

বাংলার আকাশে যেন দিনটিতে একটু ভিন্ন আলো ঝরে। কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ার আখড়ায় জমে ওঠে উৎসবের আবহ। বাউল, ফকির, সাধক, গবেষক, সংস্কৃতিকর্মী—সবাই একত্র হন এক নামের মেলায়; সেই নাম ফকির লালন শাহ্। ১৭৭৪ সালের ১৭ অক্টোবর এই মহান মানবতাবাদী ব্যক্তিত্বের জন্ম। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর তার মৃত্যু হয়। একই দিনে তাঁর জন্ম এবং মৃত্যুবার্ষিকী। দুই শতাধিক বছর পেরিয়েও লালনের দর্শন, গান, মানবতাবাদ, সমগ্র সৃষ্টি আজও সময়ের আয়নায় আশ্চর্য দীপ্তি ছড়ায়।

লালন শাহ ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন বাঙালি আধ্যাত্মিক সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক ও বাউল গানের অগ্রদূত। যিনি অসংখ্য গান রচনা ও পরিবেশন করেছেন। এ ছাড়া তিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ্, মহাত্মা লালন ইত্যাদি বিচিত্র নামেও পরিচিত ছিলেন। জনশ্রুতি আছে, তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে সঙ্গীদের দ্বারা পরিত্যক্ত হন। পরে সিরাজ সাঁই নামক একজন মুসলমান ফকিরের কাছে বাউল ধর্মে দীক্ষিত হন।

তখন থেকেই তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও একতার পক্ষে উদ্বুদ্ধ হন। তাঁর গানে ‘মানুষ’ ও মানবতাবাদের জয়গান তুলে ধরেন। তাঁর জীবন কাহিনি কিছুটা কিংবদন্তীর মতো হলেও তিনি হিন্দু-মুসলিম উভয় শাস্ত্রের গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। নিজ সাধনাবলে এক আধ্যাত্মিক দর্শন গড়ে তোলেন।

তখন সামাজিক কুপ্রথা, বিশেষ করে জাতিভেদ ও ধর্মীয় বিভেদ নিয়ে তিনি প্রতিবাদ করেছেন। সব মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। আজকের বিশ্বে ধর্ম, বর্ণ এবং জাতির মধ্যে ভেদাভেদ প্রকট আকার ধারণ করে আছে। লালন ফকির ২০০ বছর আগেই এ ভেদাভেদের বিপক্ষে গিয়ে সমতা এবং মানবতার জয়গান গেয়েছেন।

তিনি কোনো জাতিভেদ মানতেন না। তাই তিনি গেয়েছেন, ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, লালন কয় জাতের কি রূপ দেখলাম না এ নজরে।’ এরূপ অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন ভাবরসে সিক্ত বলে লালনের গান বাংলার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে সমান জনপ্রিয়। তাঁর ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘বাড়ির কাছে আরশী নগর’, ‘আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে’ প্রভৃতি গান বাউল সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তাঁর সৃষ্টিকর্ম আজকের বিশ্বে অনন্য নজির স্থাপন করে আছে। তাঁর সৃষ্টিকর্ম আজ বিভেদের পরিবর্তে সবাইকে ‘মানবতা’ নামক ছাতার নিচে আবদ্ধ করার অনুপ্রেরণা জোগায়।

মীর মশাররফ হোসেনও তাঁর গানের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। কুষ্টিয়ার কাঙাল হরিনাথ তাঁর অতি প্রিয় শিষ্য ছিলেন। কুষ্টিয়ার শিলাইদহে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন শাহের ২৯৮টি গান সংগ্রহ করেন। সেগুলো থেকে ২০টি গান তিনি প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করেন। তিনি মানবধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধ ও বক্তৃতায় লালনের গানের উল্লেখ করেন।

প্রতি বছর দোল পূর্ণিমা ও মৃত্যুবার্ষিকীতে ভক্তবৃন্দ তাঁর মাজারে একত্রিত হয়ে ৩ দিন ধরে সাধুসেবা ও সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কালজয়ী এ মহান ব্যক্তি পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য মানবিকতার নজির স্থাপন করে গেছেন। তাঁর সৃষ্টিকর্ম জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমেই আমরা অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করে আগামীর বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছি।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

এসইউ/জিকেএস

Read Entire Article