শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ন্যায়বিচার

3 hours ago 4

সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ও সুখ-সমৃদ্ধির জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা একান্ত অপরিহার্য। শান্তি আর সম্প্রীতির জন্য ন্যায়বিচার অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় ব্যক্তি ও মানব জীবনের সব শাখায় শরিয়তসম্মত জীবন বিধানে যার যে হক বা পাওনা- তা আদায়ের সুব্যবস্থা করা সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডকে ‘আদল’ বলা হয়। অত্যাচারের প্রতিবিধান এবং বিচারে ন্যায়ের মানদণ্ড এমনভাবে ধারণ করা, যাতে পক্ষদ্বয়ের কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব না হয়, এটাও আদল।

ন্যায়বিচারকারীদের বিষয়ে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ন্যায়বিচারকারী আল্লাহর নিকটে আরশের ডানে নুরের মিম্বরে অবস্থান করবে। এ অবস্থানে ওইসব লোক থাকবে, যারা নিজের পরিবার এবং নিজের জনগণের প্রতি ইনসাফের সহিত বিচারকার্য সম্পন্ন করে (মুসলিম)।

সমাজ ও দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ন্যায়বিচারের বিকল্প নাই। বিশ্বজুড়ে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে ন্যায়বিচারের অভাব। দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে বড় ধরনের অপরাধ করার পরেও অপরাধী কোনো না কোনো ভাবে শাস্তি থেকে মুক্ত হয়ে যাচ্ছে আর অপরাধীকে সার্বিক সহযোগিতাও করছে একটি মহল। অথচ পবিত্র কুরআনের শিক্ষা হচ্ছে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যদি নিজ পিতামাতার বিরুদ্ধেও সাক্ষ্য দিতে হয় তা যেন দেয়া হয়। আর আমরা আজ করছি উলটো, অপরাধী নিজের আত্মীয়স্বজন হলে তাকে কীভাবে রক্ষা করা যায় সেই চেষ্টায় রত হই।

সমাজের সকল কর্মকাণ্ড যদি ন্যায়বিচারের সঙ্গে হয়, তাহলে সমাজের প্রতিটি লোকের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরিত হয়। ন্যায়বিচার বা ন্যায়দণ্ডের ছায়াতলে সবাই ভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়। পক্ষান্তরে ন্যায়বিচারের অভাবে প্রতিহিংসা দানা বাঁধতে থাকে এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয়। বিশ্বনবি (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বংশমর্যাদা, বিত্ত-বৈভব আর গায়ের রঙের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে ভেদবুদ্ধির প্রচলিত ধারণাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে তিনি সর্বমানবিক সমতা ও সমঅধিকারের অভূতপূর্ব সনদ ঘোষণা করে সম্প্রীতির যে বন্ধন রচনা করেছেন তা সবার জন্য অনুকরণীয়।

আজ যারা সমাজ ও দেশে নানা অপকর্ম করছে তারা তো কোনো না কোনো পরিবারেরই সদস্য। অপরাধীদের পরিবার যদি প্রথমে সোচ্চার হত তাহলে অপরাধের মাত্রা এমনিতেই অনেক কমে যেত কিন্তু আমরা তা করছি না। এজন্যই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইসলাম অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহপাক হলেন সবচেয়ে বড় ন্যায়বিচারক। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যেহেতু আল্লাহরই কাজ, তাই শাসনকার্যে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট সবাইকে আল্লাহপাক এ নির্দেশই প্রদান করেন, তারা যেন ন্যায়পরায়ণতা, দক্ষতা এবং নিরপেক্ষতার সাথে নিজেদের কর্তব্য পালন করেন।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে যারা ইমান এনেছ! আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সাক্ষ্যদাতা হিসেবে তোমরা দৃঢ়ভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকারী হও, এমনকি সেই সাক্ষ্য তোমাদের নিজেদের বা পিতামাতার অথবা নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে গেলেও। যার সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়া হচ্ছে, সে ধনী হোক বা গরীব, আল্লাহ্ উভয়েরই সর্বোত্তম অভিভাবক। অতএব তোমরা যাতে ন্যায়বিচার করতে সক্ষম হও, সেজন্য তোমরা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করো না আর তোমরা যদি পেঁচানো কথা বল অথবা সত্য এড়িয়ে যাও, তবে মনে রেখো, তোমরা যা কর সে বিষয়ে নিশ্চয় আল্লাহ পুরোপুরি অবগত আছেন’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১৩৫)।

এ আয়াতে শুধু সুবিচারের কথাই স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়নি, বরং সুবিচার প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য শর্তাবলিও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, শুধু সুবিচার প্রতিষ্ঠাই নয়, বরং সুবিচারের পতাকাকেও সমুন্নত রাখতে হবে। যেখানেই ন্যায়বিচার ভূলুণ্ঠিত হতে দেখা যাবে, সেখানে তা সমুন্নত করাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। মামলায় কোন পক্ষের হার-জিতের জন্য সাক্ষ্য নয়, বরং শুধু মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই সাক্ষ্য দিতে হবে। কেননা, সত্য সাক্ষ্য ব্যতিরেকে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সত্য সাক্ষ্য দিতে গিয়ে যদি নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগে অথবা নিজ পিতামাতার বা নিকটাত্মীয় পরিজনের প্রতিকূলেও যদি যায়, তবুও সত্য সাক্ষ্য দিতে হবে। ন্যায়বিচারের উচ্চ মানদণ্ড ছাড়া সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। তাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে একমাত্র সত্যকেই মাধ্যম বানাতে হবে।

অপর এক স্থানে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘হে যারা ইমান এনেছ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা ন্যায়ের পক্ষে সাক্ষী হিসেবে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হও আর কোন জাতির শত্রুতা যেন কখনোই তোমাদেরকে অবিচার করতে প্ররোচিত না করে। তোমরা সদা ন্যায়বিচার করো। এ কাজটি তাকওয়ার সবচেয়ে নিকটে। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো। তোমরা যা কিছু কর, নিশ্চয় আল্লাহ-সে বিষয়ে পুরোপুরি অবগত আছেন’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৮)।

উক্ত আয়াতের নিরিখে হজরত ওমর ফারুক (রা.) কাযি শুরায়হ-এর নামে একটি আদেশ লিখে পাঠিয়েছিলেন। তিনি (রা.) লিখেন ‘বিচার সভায় দরকষাকষি করবে না, কারো সাথে বিবাদে লিপ্ত হবে না। কোন ধরনের ক্রয়-বিক্রয় করবে না এবং রাগান্বিত অবস্থায় তুমি দুই ব্যক্তির মধ্যে বিচারের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করবে না’ (তানতাবি, ওমর ইবনুল খাত্তাব, পৃ: ৩০৭)।

ইসলাম একটি শান্তিপ্রিয় ধর্ম এবং এর শিক্ষা অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের। ইসলামের শিক্ষাগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো সমাজ ও দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহপাকের পক্ষ পৃথিবীতে এ পর্যন্ত থেকে যত নবির (আ.) আগমন ঘটেছে, তাদের প্রত্যেককে আল্লাহতায়ালা বিশেষ যে-সব দায়িত্ব দিয়েছেন তার মধ্যে প্রধান দায়িত্ব হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

আল্লাহতায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী সকল নবিই (আ.) দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করেছেন এবং এক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন। ইসলামে ন্যায়বিচারের শিক্ষা এমন এক অনিন্দ্যসুন্দর শিক্ষা, যা ন্যায়পরায়ণ প্রত্যেক অমুসলিমও শুনে প্রশংসা না করে পারে না।

পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করাই মহানবির (সা.) আগমনের উদ্দেশ্য এবং তিনি নিজ আমল দ্বারা সর্বত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষমও হয়েছিলেন।

পবিত্র কুরআনে যেভাবে বলা হয়েছে ‘বল, আমার প্রভু আমাকে ন্যায়বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ২৯)। আল্লাহতায়ালার অনুপম শিক্ষা এবং ইসলামের সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির বহিঃপ্রকাশ তখনই সম্ভব হবে, যখন প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহপাকের প্রতিটি আদেশের ওপর আমল করবে।

ন্যায়বিচারের আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিজেদের ঘর, সমাজ, আপন-পর, এমনকি শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার সাথে ন্যায়সুলভ ব্যবহারের মাধ্যমেই আমরা মহানবির (সা.) প্রকৃত অনুসারী বলে দাবি করতে পারি।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক আরো ইরশাদ করেন ‘আর মুমিনদের দু’দল যুদ্ধে লিপ্ত হলে তাদের মাঝে তোমরা মীমাংসা করে দিও। এরপর তাদের মাঝে একদল অন্যদলের বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘন করলে যে দল সীমালঙ্ঘন করে, তারা আল্লাহর সিদ্ধান্তের দিকে ফিরে না আসা পর্যন্ত তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। এরপর তারা আল্লাহর সিদ্ধান্তের দিকে ফিরে এলে তোমরা উভয়ের মাঝে ন্যায়পরায়ণতার সাথে মীমাংসা করে দিও এবং সুবিচার করো। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালোবাসেন’ (সুরা আল হুজুরাত: ৯)।

আন্তর্জাতিক শান্তি বজায় রাখার ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের এই নীতিমালা এক মহা রক্ষাকবচ। মুসলিম বিশ্ব যদি আজ পবিত্র কুরআনের এই নীতির ওপর আমল করে, তাহলে বিশ্বময় অরাজকতার কোন প্রশ্নই থাকবে না।
মহানবির (সা.) নির্দেশ হলো ‘তুমি নিজের জন্য যা পছন্দ কর, অন্যদের জন্যও তা পছন্দ কর’। আমরা যদি এই হাদিসের ওপর দৃঢ়-প্রতিষ্ঠিত হই, তাহলেই কেবল ন্যায়বিচার করা সম্ভব। সাধারণত আমরা কি দেখি, নিজের অধিকার পুরোপুরি আদায়ের ক্ষেত্রে বদ্ধ পরিকর, অথচ অন্যের অধিকারের বিষয়ে সামান্যতম চিন্তাও করি না।
সত্য ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য আমাদেরকে যদি নিজ আত্মীয়স্বজন ও বয়োজ্যেষ্ঠদের অসন্তুষ্টিরও সম্মুখীন হতে হয়, তারপরও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কোন ধরনের পক্ষপাতিত্ব করা যাবে না। আমরা নিজেরা যখন ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকব, তখনই আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারি। নিজের মধ্যেই যদি ন্যায়পরায়ণতা না থাকে, তাহলে অপরকে কীভাবে উপদেশ দিতে পারি?

হজরত মহানবি (সা.) এরশাদ করেন, শোনো! তোমাদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি হাকিম এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তার অধীনদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। অতঃপর যে আমির লোকদের ওপর হাকিম সে তার অধীন লোকদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। পুরুষ তার পরিবারের জন্য হাকিম। সে তার অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর ঘর ও তার সন্তানদের ওপর হাকিম। সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। চাকর তার মালিকের সম্পদের ওপর হাকিম। সে তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। সাবধান, তোমরা প্রত্যেকেই হাকিম আর প্রত্যেক ব্যক্তি তার অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে (মুসলিম)।

আজকে ন্যায়বিচারের বড়ই অভাব আর এ কারণেই বিশ্বজুড়ে অশান্তি, রক্তপাত, বিশৃঙ্খলা, সামাজিক অস্থিরতা আর অরাজকতা দেখা দিচ্ছে। হজরত হাসান বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা কোনো অধীনদের ওপর হাকিম বানাবেন আর ওই ব্যক্তির যেদিন মৃত্যুবরণ করবে সেদিন ওই অধীনদের সঙ্গে খেয়ানত করে মরবে তাহলে আল্লাহতায়ালা তার ওপর জান্নাত হারাম করে দেবেন (মুসলিম )।

সমাজের সকল কর্মকাণ্ড যদি ন্যায়বিচারের সঙ্গে হয়, তাহলে সমাজের প্রতিটি লোকের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরিত হয়। ন্যায়বিচার বা ন্যায়দণ্ডের ছায়াতলে সবাই ভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়। পক্ষান্তরে ন্যায়বিচারের অভাবে প্রতিহিংসা দানা বাঁধতে থাকে এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয়। বিশ্বনবি (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বংশমর্যাদা, বিত্ত-বৈভব আর গায়ের রঙের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে ভেদবুদ্ধির প্রচলিত ধারণাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে তিনি সর্বমানবিক সমতা ও সমঅধিকারের অভূতপূর্ব সনদ ঘোষণা করে সম্প্রীতির যে বন্ধন রচনা করেছেন তা সবার জন্য অনুকরণীয়।

আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে প্রকৃত অর্থে ইসলামের সুন্দর শিক্ষা বুঝার এবং তা নিজ জীবনে পালন করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
[email protected]

এইচআর/জিকেএস

Read Entire Article