চলতি মূলধনের ঘাটতি, ডলারের সংকট ও উচ্চমূল্য এবং গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে পড়েছে দেশের কিছু বড় বড় প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঋণপত্র (এলসি) খোলার সমস্যা। কিছু ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলতে না পারায় কাঁচামালও আমদানি করতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে আগামী রমজানে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, কিছু ব্যাংকের বিশেষ করে ইসলামি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে অসহযোগিতা করছে। যার কারণে দেশের তেল-চিনিসহ সব ধরনের নিত্যপণ্য ও ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন, রড-সিমেন্টসহ নির্মাণশিল্পের তৈরি উপকরণ, ওষুধ, সিরামিক ও বস্ত্র খাতের মতো বৃহৎ শিল্পগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
এলসি খুলতে না পারায় সম্প্রতি সার্বিক তথ্য তুলে ধরে সরকারের উচ্চপর্যায়ে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে চিঠি দিয়েছে দেশবন্ধু গ্রুপ। বিষয়টি আমলে নিয়ে গত বছরের ৩ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে যথাযথ নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেওয়া হয় (যার স্মারক নম্বর ০৩০০২৬৯০০৭৩০০০০১২৪-১৫৪)।
তার আগে গত বছরের ২৮ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও একটি চিঠি দেওয়া হয় (যার স্মারক নম্বর ৫৩২০৪০৩৩৩৮০০১২৪২৯৩)। সবশেষ গত ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে আরেকটি চিঠি দেওয়া হয় (যার স্মারক নম্বর বিআরপিডি (পি)/৬৬১/১৩/আরআর(এম)/২০২৪-১১০০৮)।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার নম্বর ১৬/২০২২ অনুযায়ী গ্রুপটির লোন রিসিডিউল করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যাংককে চিঠি দেয় দেশবন্ধু গ্রুপ। তবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি- এ তিনটি ইসলামী ব্যাংক লোন রিসিডিউল করেনি। বরং বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্টে ক্লাসিফাইড হিসেবে প্রদর্শন করেছে।
আরও পড়ুন
এ অবস্থায় বিষয়টি সুরাহার জন্য উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয় দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপরিবার দেশবন্ধু গ্রুপ। হাইকোর্ট সার্বিক দিক বিবেচনা করে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে দেশবন্ধু গ্রুপের লোনগুলো রিসিডিউল করে ব্যবসা পরিচালনা করার নির্দেশনা দেন।
এদিকে, গত ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক উল্লেখিত তিনটি ইসলামী ব্যাংককে দেশবন্ধু গ্রুপের কোম্পানিগুলোর সুদ মওকুফ করে ব্যাংক হিসাবগুলো নিয়মিতকরণ এবং নিয়মিত ব্যাংকিং কার্যক্রম করার জন্য চিঠি দেয় (যার স্মারক নং বিআরপিডি(ডি-১) পি/৬৬১/১৩/আরআরএম/২০২৪-১১৫৫৬)। এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে দেশবন্ধু গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের চিঠি দেয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ব্যাংকগুলো তা করেনি।
ফলে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এবং দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে ব্যাংকগুলোর অসহযোগিতার কারণে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে।
জানা গেছে, গ্রুপটির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান দেশবন্ধু সুগার মিলস ২০১৭ সাল থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসির সঙ্গে, ২০১৯ সাল থেকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির সঙ্গে এবং ২০২৩ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ২০১৭ সাল থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত দেশবন্ধু গ্রুপের সাতটি কোম্পানির অনুকূলে মোট ৪ হাজার ৯৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ দেয়। এ ঋণের বিপরীতে পরিশোধ করে ৩ হাজার ৬০৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ২০১৯ সাল থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত দেশবন্ধু গ্রুপের পাঁচটি কোম্পানির অনুকূলে মোট ১ হাজার ৫৪৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা ঋণ দেয়। ঋণের বিপরীতে পরিশোধ করা হয় ১ হাজার ১৪৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। একই ভাবে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ২০২৩ সাল থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত দেশবন্ধু সুগার মিলসের অনুকূলে মোট ৭৫৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ দেয়। যেখানে পরিশোধ হয় ৩৮০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী গ্রুপটি ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী এই ক্ষতির টাকা গত আট বছরের মধ্যে পরিশোধ করার কথা থাকলেও ব্যাংকগুলো এখনো তা দেয়নি।
সাবেক সচিব ও দেশবন্ধু গ্রুপের নির্বাহী পরিচারক (ইডি) মোমতাজুল ইসলাম বলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। তারপর দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা। কিন্তু সেটির বাস্তবায়নে বিঘ্ন ঘটায় চতুর্মুখী সংকটে পড়েছে দেশের শিল্পখাত।
তিনি বলেন, দেশের বেশ কয়েকটি বড় বড় শিল্পগ্রুপ এরই মধ্যে এলসি খুলতে না পেরে তাদের উৎপাদন কমিয়েছে। এমনকি কেউ কেউ কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এরমধ্যে চট্টগ্রামভিত্তিক ও ঢাকার কয়েকটি শিল্পগ্রুপ অন্যতম। যারা বিদেশ থেকে শিল্পের কাঁচামাল এনে পণ্য উৎপাদন করে ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিচ্ছে। অথচ তাদের অনেক ব্যাংক শতভাগ ক্যাশ মার্জিন দেওয়া সত্ত্বেও এলসি করতে অপারগতা প্রকাশ করছে। ক্রমেই এ পরিস্থিতি আরও প্রকট হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ব্যাংকে বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকগুলোর এলসি, বিদেশি ব্যাংক (এডিডি) কনফারমেশন করছে না। ফলে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। সামনে রমজান মাস, দেশের ভোগ্যপণ্য চাহিদা দ্বিগুণ হবে। কিন্তু সেই অনুযায়ী এলসি খোলা এবং তার বিপরীতে মাল শিপমেন্টের অবস্থা সন্তোষজনক নয়।
দেশবন্ধু গ্রুপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জাকির হোসেন বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বড় বড় শিল্পগ্রুপের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব যোগ হয়েছে। অতি সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকগুলো বিভিন্ন শিল্পগ্রুপের কোনো এলসি না করে শুধু পূর্ববর্তী ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতির শিকার দেশবন্ধু গ্রুপ।
তিনি জানান, গ্রুপটির অধীনে ২৮টি কোম্পানির প্রায় ১৭ ধরনের শিল্প-কারখানা রয়েছে, যেখানে ২৫ হাজারের (বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পসহ) বেশি লোকের কর্মসংস্থান। ইসলামী ব্যাংকগুলো কিছুদিন ধরে শতভাগ ক্যাশ মার্জিন দেওয়ার পরও এলসি দিচ্ছে না। এমনকি সাপ্লাইয়ার ক্রেডিট কন্ট্রাক্টের আওতায় কাঁচামাল আমদানি করতেও সহায়তা করছে না। যদিও এতে ব্যাংকগুলোর কোনো প্রকার দায় সৃষ্টি হয় না।
আরও পড়ুন
- এলসি খোলায় জটিলতাকে ব্যবসা বড় বাধা মনে করেন উদ্যোক্তারা
- রমজানের নিত্যপণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন থাকবে না: গভর্নর
এ বিষয়ে দেশবন্ধু গ্রুপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও গ্রুপ প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) বশির আহমেদ জানান, ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ভালোভাবে ব্যবসা করে আসছিল দেশবন্ধু সুগার মিল। তখন দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক দেশবন্ধু সুগার মিলের ভালো প্রশংসা করছিল। এ মর্মে কোম্পানিটির কাছে কয়েকটি ব্যাংকের প্রশংসাপত্র রয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১০ সালের পর ২০১১ সালে তৎকালীন সরকার কোম্পানির কর্মকর্তাদের ডেকে উচ্চমূল্যে সুগার আমদানি করতে বাধ্য করে। যার ফলে দেশবন্ধু সুগার মিলের ৩৭৮ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। অর্থাৎ, যখন দেশবন্ধু সুগারের বার্ষিক টার্নওভার ছিল ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা, তখন এক আমদানিতেই কোম্পানির ৩৭৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অর্থাৎ সব অথরিটির কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়।
‘ওই চিঠিতে বলা হয়, সরকারের কথা অনুযায়ী দেশবন্ধু সুগার মিলসের সুগার আমদানি করে। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো কোম্পানির ক্ষতি হলে বিষয়টি সরকার দেখবে। সরকারের কথা অনুযায়ী তখন কোম্পানির ক্ষতির ৩৭৮ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য যথাযথ নিয়ম মেনে আবেদন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অদ্যাবধি ক্ষতির সে টাকা ফেরত পায়নি কোম্পানি’- বলেন বশির আহমেদ।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলো দেশবন্ধু গ্রুপের কাছে ঋণের কিছু টাকা পাবে এটি সত্য এবং তা যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিশোধও করা হচ্ছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের এই মহাসংকটময় সময়ে ঋণ পরিশোধে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। যার কবলে শুধু দেশবন্ধু গ্রুপই পড়েনি, বরং দেশের সব ধরনের কোম্পানি সাফার করছে।
বশির আহমেদ বলেন, দেশবন্ধু গ্রুপের মতো শিল্পপ্রতিষ্ঠান একদিনে প্রতিষ্ঠা হয়নি। এটি দেশের অনেক বড় সম্পদ। বিগত দিনে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন শিল্পগ্রুপের অনুকূলে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি সুদ মওকুফ করেছে। এমনকি বিভিন্ন সময়ে কোনো কোনো শিল্পগ্রুপকে নতুন করে চলতি মূলধন হিসেবে অর্থের জোগানও দিয়েছে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় করপোরেশনগুলো দেশ স্বাধীনের পর থেকে অদ্যাবধি কোটি কোটি টাকা লোকসানের পরও ভর্তুকি দিয়ে কর্মসংস্থান ঠিক রেখেছে।
‘এ ধারাবাহিকতায় দেশের হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের স্বার্থে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দেশে ও বিদেশের মানদণ্ড ঠিক রেখে এই বৃহৎ শিল্প কারখানাগুলোকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, তার একটি দিকনির্দেশনা দিতে পারে’- যোগ করেন তিনি।
এমএএস/এমকেআর