ভারত সীমান্তঘেঁষা শেরপুর সীমান্তে মানুষের সঙ্গে বন্যহাতির দ্বন্দ্ব দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বনাঞ্চল উজাড়, বসতির সম্প্রসারণ ও খাদ্যের অভাবে হাতির দল লোকালয়ে নেমে আসছে, নষ্ট করছে ফসল ও বাড়িঘর। ক্ষুব্ধ কৃষকরা নিজেদের সম্পদ রক্ষায় ফাঁদ হিসেবে বিদ্যুতের জিআই তার ব্যবহার করছেন, যার ফলে একের পর এক হাতি মারা পড়ছে। আবার ক্ষিপ্ত হাতির আক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছেন এলাকাবাসী।
এবার হাতি-মানুষের এই চলমান দ্বন্দ্ব নিরসনে ১০২ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকাজুড়ে সোলার ফেন্সিং প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছে বন বিভাগ। এর আওতায় আগে স্থাপিত ১৩ কিলোমিটার সোলার ফেন্সিংয়ের রক্ষণাবেক্ষণ ও নতুন করে ৮৯ কিলোমিটার এলাকা সোলার ফেন্সিংয়ের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছে ময়মনসিংহ বন বিভাগ।
মঙ্গলবার (১১ মার্চ) বিকেলে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার রাঙটিয়া রেঞ্জের বনরাণী ফরেস্ট রিসোর্টে ময়মনসিংহ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আ.ন. ম. মো. আব্দুল ওয়াদুদের সভাপতিত্বে হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যে করণীয় শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য জানানো হয়।
মতবিনিময় সভায় ঢাকার বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. ছানাউল্লাহ পাটোওয়ারী বলেন, ‘বন্য হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচতে চলতি বছর সচেতনতা কার্যক্রম বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর আওতায় বন্যহাতির জন্য নিরাপদ অভয়াশ্রম নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে সোলার ফেন্সিং প্রকল্পের মাধ্যমে এই দ্বন্দ্ব নিরসনে স্থায়ী সমাধান নেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় জনগণ ও এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম (ইআরটি) সদস্যদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। যেন একটি হাতিও না মরে, আবার কোনো মানুষেরও যেন ক্ষতি না হয়।’
এসময় তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশসহ পৃথিবীতে ১৩টি রাষ্ট্রে হাতি রয়েছে। এটা আমাদের গৌরবের বিষয়। হাতি ও মানুষের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকে গভীরভাবে দৃষ্টি দিয়েছেন আমাদের পরিবেশ উপদেষ্টা। এজন্য তিনি স্থানীয় জনগণ ও এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম (ইআরটি) সদস্যদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সেজন্য যা যা করার দরকার, সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে। এক মাস পরই ধানের মৌসুম আসবে, তখন লোকালয়ে বন্যহাতি নেমে আসবে। এই সময়ে সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
তথ্যমতে এক সময় গারো পাহাড়ের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল ছিল হাতির অবাধ বিচরণভূমি। তবে সময়ের সঙ্গে বনভূমি দখল ও কৃষিজমিতে রূপান্তরের ফলে হাতির স্বাভাবিক বাসস্থান সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ১৯৯৫ সালে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় থেকে দলছুট হয়ে আসা প্রায় ২০-২৫টি হাতি গারো পাহাড়ে প্রবেশ করে। বর্তমানে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০-৭০টিতে। কিন্তু তাদের বসবাসের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই, নেই পর্যাপ্ত খাদ্যও। ফলে তারা বাধ্য হয়ে গ্রাম ও চাষের জমিতে হানা দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হাতির এই অস্বাভাবিক অভিবাসনের পেছনে অন্যতম কারণ হলো বন উজাড় ও পাহাড়ি এলাকায় বসতির সংখ্যা বৃদ্ধি। শেরপুরের সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলায় গারো, কোচ, ডালু, বানাই ও হদি আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে। সময়ের সঙ্গে তাদের সংখ্যা বেড়েছে এবং বনভূমি দখল করে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। এতে বনাঞ্চল সংকুচিত হয়ে হাতির আবাসস্থল প্রায় ধ্বংসের পথে। ফলে হাতির দল বাধ্য হয়ে মানুষের এলাকায় আসছে, আর সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে।
সভায় পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. সাইফুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ মো. মদিনুল আহসান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ ও আরণ্যক ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম অফিসার ড. মোহাম্মদ আব্দুল মোতালেব এবং ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম রাসেল প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
ইমরান হাসান রাব্বী/এফএ/জেআইএম