করোনা মহামারিতে একটি ব্যবসায় ক্ষতির মুখে পড়েন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থ ও হিসাব বিভাগ থেকে এমবিএ পাস করা যুবক মনিরুজ্জামান সজীব। ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে নতুন ব্যবসার চিন্তা থেকে জৈব সার কারখানা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু এমন ফার্ম করতে যে অভিজ্ঞতা দরকার সেটি ছিল না তার। পরে স্থানীয় কৃষি অফিসের দ্বারস্থ হন তিনি। কৃষি কর্মকর্তার দেওয়া পরামর্শে বিভিন্ন জেলার এগ্রো ফার্ম পরিদর্শন করেন। এরপর নিজ গ্রামেই গড়ে তোলেন ‘হারুন অর্গানিক এগ্রো ফার্ম’ নামে একটি জৈব সার কারখানা।
মনিরুজ্জামান সজীবের বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রঘুনন্দনপুর গ্রামে। ২০২০ সাল থেকে শুরু হয় তার এ কার্যক্রম। বর্তমানে দুই ধরনের জৈব সার তৈরি করছেন তিনি। ট্রাইকো কম্পোস্ট ও ভার্মি কম্পোস্ট। এখান থেকে নিয়মিত জৈব সার উৎপাদন ও সরবরাহ করছেন। এই সার এখন ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মাগুরা, ফরিদপুর, যশোর, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, নাটোর, পাবনা ও রাজশাহীতেও যাচ্ছে।
মনিরুজ্জামান সজীবের মতে, সরকার যদি বেসরকারিভাবে কৃষকদের জৈব সার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে, সার ব্যবসায়ীদের জৈব সার বিক্রির জন্য রাসায়নিক সারের পাশাপাশি জৈব সারের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয় এবং জৈব সারের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে কৃষক এই সার ব্যবহারে আগ্রহী হবেন। তখন সার ব্যবসায়ীরাও এ সার বিক্রি করবেন।
অল্প সময়ের ব্যবধানে উদ্যোক্তা মনিরুজ্জামান সজীবের জৈব সার কারখানাতে ১৫ জন শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এখানে কাজ করে তারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন। এসব শ্রমিকের ভেতরে ১২ পুরুষ ও তিনজন নারী শ্রমিক রয়েছেন।
উদ্যোক্তা মনিরুজ্জামান সজীবের হারুন অর্গানিক এগ্রো ফার্মে প্রতিমাসে ৬০ টন ট্রাইকো কম্পোস্ট ও ৬ টন ভার্মি বা কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত কাঁচামালের অভাবে কাঙ্ক্ষিত সার উৎপাদন করতে পারছেন না তিনি। এই সার উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল হচ্ছে গোবর। তবে তার নিজস্ব গরুর খামার না থাকায় বা এলাকায় স্থানীয়দের তেমন খামার না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন বা সরকারের অন্যান্য দপ্তর থেকে এই উদ্যোক্তাকে সহজ শর্তে জামানতবিহীন লোনের সুযোগ করে দিলে নিজস্ব গরুর খামার করে কাঁচামালের চাহিদা পূরণ করতে পারবেন। পাশাপাশি স্থানীয়দের উদ্বুদ্ধ করার মতো কিছু সরকারি কার্যক্রমও দরকার রয়েছে বলে মনে করেন উদ্যোক্তা সজীব।
সরেজমিন দেখা গেছে, জৈব সার উৎপাদনে অন্যান্য যে কাঁচামালের জোগান লাগে, তার মধ্যে ট্রাইকো কম্পোস্টে ট্রাইকো ডার্মা পাউডার, গরুর গোবর, আখের গাদ, কলাগাছ, কচুরিপনা, ছাই, খৈল, চিটাগুড়, কাঠের গুঁড়া, সবজির উচ্ছিষ্ট, ডিমের খোসা, নিম খৈল, হাড়ের গুঁড়া, শিং কুচি, গাছের পাতা পচা, ব্যবহৃত চা পাতাসহ ইত্যাদি কাঁচামাল লাগে। এগুলো একত্র করে পর্যায়ক্রমে সেডে পচন ক্রিয়ার মাধ্যমে ৪৫ থেকে ৫৫ দিনের মধ্যে উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার বানানো হয়। আর ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো কম্পোস্টে গরুর গোবর, কলাগাছ ও কচুরিপনা লাগে। কেঁচো এগুলো খেয়ে যে মলত্যাগ করে তাই উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার। এসব জৈব সারে পিএইচ, জৈব কার্বন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, কপার, সালফার, জিংক, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও ম্যাগনেশিয়ামসহ রয়েছে নানা বৈজ্ঞানিক উপাদান।
প্রত্যন্ত পল্লির উদ্যোক্তা মনিরুজ্জামান সজীবের জৈব সার স্থানীয় কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। স্থানীয় কৃষকরা জানান, গ্রামে জৈব কারখানা হওয়াতে তারা কম মূল্যে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য সার ক্রয় করে উপকৃত হচ্ছেন এবং অন্যান্য কোম্পানির সারের তুলনায় এই সার অনেক উপকারী ও নিরাপদ।
শৈলকুপা কৃষি অফিস জানায়, এমন জৈব সারের রয়েছে নানা উপকারিতা। ফলন বৃদ্ধি ও গুণগত মান বাড়ায়, সব ঋতুতে সব ফসলে ব্যবহার করা যায়। জৈব সার বীজের অংকুরোদগমে সহায়তা করে, মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, মাটির গঠন ও প্রকৃত গুণ রক্ষা করে, মাটির উপকারী জীবাণুগুলোর বংশবৃদ্ধি ও কার্যকারিতা বাড়ায়, মাটিতে রস মজুত রাখতে সহায়তা করে, ফলে অধিক সেচের প্রয়োজন হয় না। জৈব সার ব্যবহারের ফলে আনুপাতিক হারে রাসায়নিক সারের মাত্রা কমানো যায়, মাটির ভেতরে বাতাস চলাচলে সাহায্য করে, ফসলের সব ধরনের খাদ্য জোগান দেয়। এই সার মাটিতে দেওয়ার পর ৬ থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত প্রভাব থাকে, যা পরবর্তী ফসলের জন্যেও কাজে লাগে।
উদ্যোক্তা মনিরুজ্জামান সজীব কালবেলাকে বলেন, জৈব সার প্রতি শতকে সবজির জন্য ৫ কেজি। পেঁয়াজ, আলু, ধান, গম, পাটসহ অন্যান্য ফসলের জন্য ৩ থেকে ৪ কেজি এবং ফল গাছে ৫ থেকে ৭ কেজি করে ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়াও সব ফসলে সবসময় এই জৈব সার ব্যবহার করা যায়।
এদিকে, প্রতি কেজি জৈব সারের উৎপাদন খরচ গড়ে ১০ টাকার বেশি। কিন্তু স্থানীয় কৃষকদের এই সার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এবং অন্যান্য বড় জৈব সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের থেকে কম মূল্যে সার বিক্রি করার জন্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদেরও কম মূল্যে সার বিক্রি করতে হচ্ছে বলে জানান সজীব। যার ফলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আশার আলো দেখতে পান না। ১৩ থেকে ১৫ টাকা দরে প্রতি কেজি বিক্রি হলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবে বলে ধারণা সজীবের।
সজীব বলেন, জৈব সার উৎপাদন এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে যে আইনগত প্রক্রিয়া রয়েছে, ক্ষেত্র বিশেষ তা শিথিল করলে বাড়বে উদ্যোক্তা। ট্রেড লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, বিসিক লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তরের লাইসেন্স, সার সমিতির লাইসেন্স এবং খামার বাড়ির লাইসেন্স। একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা যদি এসব লাইসেন্স বা প্রক্রিয়ার কথা শোনেন, তাহলে এমনিতেই সে কাজ শুরু করবেন না। ভয়ে পিছিয়ে যাবেন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করে কৃষি অফিসের তদারকিতে জৈব সার উৎপাদন ও সার সরবরাহের ব্যবস্থা করলে নির্ভরতা কমতে পারে রাসায়নিক সারের ওপর। এ ছাড়াও জৈব সারের মান পরীক্ষা করার জন্য স্থানীয় বা জেলা পর্যায়ে পরীক্ষাগার করা উচিত। কারণ প্রতিবার জৈবসারের মান পরীক্ষার জন্য একজন উদ্যোক্তাকে বিভাগীয় শহর বা ঢাকা থেকে পরীক্ষা করাতে হয় এবং ফি-এর পরিমাণও অনেক বেশি।
শৈলকুপা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান জৈব সারের উৎপাদন, ব্যবহার ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রসঙ্গে বলেন, শৈলকুপার প্রত্যন্ত পল্লিতে যে ‘হারুন অর্গানিক এগ্রো ফার্ম’ গড়ে উঠেছে, তা আমাদের জন্য সুখবর। কৃষকদের জৈব সার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে।