সরকারি টাকায় কেনা ওষুধে ‘বেসরকারি মোড়ক’

2 months ago 9

সরকারি হাসপাতালে ওষুধ বাইরে বিক্রির অভিযোগ নতুন নয়। তবে বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট নিয়ম ভেঙে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ওষুধ কিনেছে কমার্শিয়াল মোড়কে, যাতে ‘সরকারি’ পরিচয় নেই। এতে বাইরে বিক্রি করলে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে—ফলে অবৈধ বেচাবিক্রির পথ আরও সহজ হয়েছে।

‘ঔষধ ও কসমেটিকস আইন-২০২২’ এ সরকারি ওষুধ চুরি করে বিক্রি করা হলে ১০ বছরের কারাদণ্ড অথবা ১০ লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান আছে। পাশাপাশি সরকারি ওষুধ চেনার জন্য পাতা/বোতল/প্যাকেটে লাল-সবুজ রং ও সরকারি সম্পত্তি বিক্রির জন্য নহে’ লিখে রাখার বিধানও যুক্ত করা হয় ক্রয় কার্যাদেশে। সম্প্রতি এই বিধান লঙ্ঘন করে ওষুধ গ্রহণ করেছে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটি একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারি ওষুধ কোম্পানি ইডিসিএল সরবরাহ করা ওষুধ নিয়ম মেনে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আলেয়া করপোরেশনের কাছ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পাঁচ কোটি টাকার ওষুধ নেওয়া হয়েছে। এগুলোই মূলত নিয়ম ভেঙে লাল-সবুজ মোড়কের পরিবর্তে কমার্শিয়াল প্যাকে দিয়েছে। এগুলো রিসিভ করতে একটি সিন্ডিকেট উৎকোচ নিয়েছে। এরাই এই ওষুধ বাইরে বিক্রির টাকার ভাগ পান।

গত ১৬ জুন প্রতিষ্ঠানটির স্টোর ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ ওষুধ কমার্শিয়াল মোড়কে। দু-একটা ওষুধে আলাদা স্টিকারে ‘বিক্রয়ের জন্য নহে’ লেখা থাকলেও সেটি সহজেই তুলে ফেলা যায়। অর্থাৎ অমোচনীয় কালি বা স্টিকার লাগানো না। এর মধ্যে Budicort0.5, Windel Pluse, Clindacin 600, Widebac 50, Synova Normal Saline (বোতল), tropex, Flindof, Pulmosis 267, Intravenous Infusion Solution, Hexisol Hand Rub, Fatisol 500ml, Protinex সহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ কমার্শিয়াল প্যাকে আছে। অথচ ঠিকাদারকে দেওয়া কার্যাদেশে লেখা আছে- ‘ভায়াল/অ্যাম্পুল/বোতল/স্ট্রিপ/প্যাকেটের গায়ে ‘লাল-সবুজ মোড়কে এবং সরকারি সম্পত্তি বিক্রয়ের জন্য নহে’ কথাটি অমোচনীয় কালি দিয়ে লিখে দিতে হবে।

লাল-সবুজ তো আমাদের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু জরুরি প্রয়োজনে এর বাইরেও কিছু নেওয়া হয়। আবার অনেক ওষুধ আছে বিদেশি, সেগুলোতে লাল-সবুজ মোড়ক থাকে না।- মেডিকেল অফিসার ডা. আ ন ম আশিকুর রহমান খান

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, আলেয়া করপোরেশনকে দেওয়া কার্যাদেশের মধ্যে কমার্শিয়াল মোড়কে দেওয়া ওষুধগুলোর নাম উল্লেখ আছে। এর মধ্যে Budicort0.5 পরিমাণে একলাখ পিস, যার মূল্য ৩৯ লাখ টাকা। Windel Pluse একলাখ ৫০ হাজার, যার মূল্য ২৯ লাখ ৮৫ হাজার ১৫০ টাকা। Clindacin 600 পাঁচ হাজার, যার মূল্য ৩ লাখ ৪৫ হাজার পাঁচ টাকা। Widebac 50 চার হাজার, মূল্য ২৩ লাখ ৬০ হাজার ৪ টাকা। এগুলোসহ তাদের কার্যাদেশে ৫৫টি আইটেমের ওষুধ আছে। যার দাম পাঁচ কোটি ১৬ হাজার ৯৩১ টাকা।

এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের অনিয়মের বিষয়ে ভ্রূক্ষেপ নেই। বরং তাদের কাছে জানতে চাইলে সাংবাদিক কীভাবে জানলো, এ নিয়ে ব্যস্ততা বেশি দেখা যায়।

হাসপাতালটির স্টোরের দায়িত্বে নিয়োজিত মেডিকেল অফিসার ডা. আ ন ম আশিকুর রহমান খান বলেন, ‘লাল-সবুজ তো আমাদের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু জরুরি প্রয়োজনে এর বাইরেও কিছু নেওয়া হয়। আবার অনেক ওষুধ আছে বিদেশি, সেগুলোতে লাল-সবুজ মোড়ক থাকে না।’

এগুলো তো জরুরি প্রয়োজনে নয়, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নেওয়া হয়েছে, এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এগুলোর জন্য কথা বলার কর্তৃপক্ষ হচ্ছে পরিচালক ও সুপারিনটেনডেন্ট। আরও তথ্য চাইলে তাদের অনুমতি লাগবে।’

অনেক সময় কম আইটেম হলেও প্রত্যাশিত প্যাক করে দিতে চায় না কোম্পানিগুলো। তখন কনসিডার করতে হয়। তারপরও যাই হোক নিয়মের ব্যত্যয় হওয়া উচিত নয়। আমরা সামনে চেষ্টা করবো, কমার্শিয়াল প্যাকে না নিয়ে লাল-সবুজ প্যাকে নিতে।- হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ডা. আবদুল্লাহ আল মেহেদী

এ নিয়ে হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ডা. আবদুল্লাহ আল মেহেদী জাগো নিউজকে বলেন, ‘পাঁচ কোটি টাকার সব ওষুধ লাল-সবুজ ছাড়া নেওয়া হয়নি। কিছু আইটেম নেওয়া হয়েছে। এটা হতে পারে মাঝে-মধ্যে। অনেক আইটেম তো, যারা সার্ভে করে তারা তো একটু ইয়ে (চোখ এড়াতে পারে) হয়ে যায়। আবার অনেক সময় কম আইটেম হলেও প্রত্যাশিত প্যাক করে দিতে চায় না কোম্পানিগুলো। তখন কনসিডার করতে হয়। তারপরও যাই হোক নিয়মের ব্যত্যয় হওয়া উচিত নয়। আমরা সামনে চেষ্টা করবো, কমার্শিয়াল প্যাকে না নিয়ে লাল-সবুজ প্যাকে নিতে।’

হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. দেলোয়ার হোসেন জাগো নিউজের কাছে উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘লাল-সবুজ সব ওষুধের ক্ষেত্রে তো হয় না। যেগুলো আমদানি হয়, সেগুলো লাল-সবুজ পাবো কোথায়?’

লাল-সবুজ প্যাক ছাড়া কমার্শিয়াল প্যাকে দেশি ওষুধেই অনেক পরিমাণ স্টোরে আছে, জানালে তিনি উল্টো প্রশ্ন করেন, আপনাকে কে বললো? জবাবে আমি নিজে স্টোরে গিয়ে দেখে আসছি বললে ‘অফিস টাইমে আসেন দেখবো’ বলে এড়িয়ে যান।

এ বিষয়ে জানতে ওষুধ সরবরাহকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আলেয়া করপোরেশনের বক্তব্য নিতে কার্যাদেশে দেওয়া তাদের ঠিকানা অনুযায়ী (১৮/৭-জে, কেএম দাস লেন, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন) গিয়ে কোনো অফিস পাওয়া যায়নি। সেটি একটি আবাসিক ভবন। বসবাসকারীরা জানিয়েছেন, সেখানে কোনো অফিস নেই।

এসইউজে/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম

Read Entire Article