শিল্প-কারখানায় গ্যাস চুরি, নিয়োগ-বদলি, পদোন্নতি ও দরপত্রে কমিশন বাণিজ্যই যেন পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (পিজিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (জিএম-প্রশাসন) সাহিনুর আলমের মুখ্য কাজ। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী ও ঠাকুরগাঁও-১ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন ও নিষিদ্ধ সংগঠন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের আশির্বাদে বেপরোয়া সাহিনুর আলম।
সম্প্রতি পিজিসিএলের আফসার আলী নামে এক গ্রাহক এমন অভিযোগ করেছেন। এতে বলা হয়েছে, জিএম সাহিনুর আলমের নেতৃত্বে পিজিসিএলকে রীতিমতো একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে ধ্বংস করা হচ্ছে। এই সিন্ডিকেটের অন্যরা হলেন- মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) শৈলজা নন্দ বসাক ও ব্যবস্থাপক (জেনারেল এডমিন) মোস্তাফিজুর রহমান।
লিখিত ওই অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) সাহিনুর আলমের নিজ জেলা ঠাকুরগাঁও। এই সুযোগে সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী ও ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন ও ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনকে ব্যবহার করে তিনি একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি জিএম হয়েও অনিয়ম-দুর্নীতির স্বার্থে ‘চায়না-বাংলা লিমিটেড’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে উন্মুক্ত দরপত্রের শর্ত ভেঙে শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ কমিশনের বিনিময়ে কাজ দেন। পরে এ কমিশন সিন্ডিকেটের সদস্যরা ভাগাভাগি করে নেন।
চায়না-বাংলা লিমিটেড ছাড়াও সাহিনুর আলম সুকৌশলে মার্কেনটাইল ও এলএস ইঞ্জিনিয়ারিং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে মালামাল ক্রয় দরপত্রে অংশ নেন। শুধু তাই না, দরপত্রের সম্ভাব্য মূল্যও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অগ্রীম জানিয়ে দেন তিনি।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেড় কোটি টাকার পাইপ লাইনের টেপ প্রাইমার ক্রয়ের দরপত্র আহ্বান করে পিজিসিএল। ওই দরপত্রে ইউরোপ আমেরিকার টেপ প্রাইমারের দর ধরে এস্টিমেট করা হয়। কিন্তু চাইনিজ প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় এজেন্ট চায়না-বাংলা লিমিটেডের প্রতিনিধি মামুনুর রশিদকে এস্টিমেট কস্ট সরবরাহ করা হয়। এ দরপত্রে অংশ নিয়ে তিনি সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হন। পরবর্তী ২০২০-২১ অর্থবছরে তারা মালামাল সরবরাহ করেন। তবে সরবরাহকৃত মালামাল স্পেসিফিকেশনে পিজিসিএলের দরপত্র অনুযায়ী ছিল না। তারপরও মোটা অঙ্কের কমিশনের লোভে সাহিনুর আলম পিজিসিএলের যাচাই কমিটি দ্বারা জোরপূর্বক গ্রহণের চাপ দেন। পরবর্তীতে তৎকালীন ডিজিএম দেবদীপ বড়ুয়া প্রেরণকৃত মালামালগুলোর গুণগতমান যাচাই করলে গ্রহণযোগ্য হয়নি। মালামালগুলো কাজের উপযোগী না হওয়ায় আজও পড়ে রয়েছে। ফলে পিজিসিএলের এ দরপত্রে দেড় কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়।
এছাড়া সম্প্রতি সরকারি সিদ্ধান্তে বিভিন্ন গ্রাহকের গ্যাস সংযোগ লিকেজ মেরামতের জন্য জরুরিভাবে ১৫ হাজার ইনসুলেটিং বুশ ক্রয় করা হয়। যা ৬০ টাকা দরে ক্রয় করে ভুয়া মেমোতে ২৫৮ টাকা দর দেখান সাহিনুর আলম ও তার সিন্ডিকেট।
এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে পিজিসিএলের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে সত্যতা পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই সব কর্মকর্তারা বলেন, জিএম দীর্ঘদিন ধরে নানান অপকর্ম করে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে কোনো কর্মকর্তা কিছু বলতে গেলে তাকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। যে কারণে আমরা নির্বাক শুধু দেখে যেতে বাধ্য হচ্ছি।
অভিযোগের বিষয়ে পিজিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) সাহিনুর আলম জাগো নিউজকে বলেন, নানা কারণে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে কেউ দিতেই পারেন। তবে অভিযোগের স্বচ্ছ ভিত্তি থাকতে হবে। আমার কাছে মনে হচ্ছে অভিযোগকারী এসব বিষয়ে অনেকখানি অজ্ঞ। অনেক সময় কাজের মৌসুমে স্বাভাবিক সময়ের চাইতে দুই তিন গুণ বেশি দামে মালামাল কিনতে হয়। মৌসুম শেষ হলে আবার সেটার দামে কমে যায়। এর মানে এই না আমিই সেটি করিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, গুনগত মান যাচাই কমিটি স্বাধীনভাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে মালামাল নিয়ে থাকেন। এখানে আমার কোনো হাত নেই। সাম্প্রতিক সময়ে মালামাল সরবরাহের একটি কোম্পানি অত্যন্ত খারাপ মালামাল সরবরাহ করেছে। যে কারণে সেইগুলো গুণগত মান যাচাই কমিটি বাদ দিয়ে রেখেছে। সেই কোম্পানির বিল পরিশোধ করা হলেও এখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
এ প্রসঙ্গে পিজিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) জিয়াউর হক জাগো নিউজকে বলেন, এ অভিযোগের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে আপনাদের কাছে যে অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো আমাদের দিলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এফএ/এমএস