স্ত্রীরা কি স্বামীর বাঁ পাঁজরের হাড় থেকে তৈরি?

6 hours ago 5
আমাদের সমাজে একটা কথা বারবারই শোনা যায় যে, ‘নারীকে পুরুষের বাঁ পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।’ অনেকে আবার একে হাদিস ভেবে নিঃসন্দেহে প্রচার করে থাকেন। অনেক কবি-লেখক তো ‘বাঁ পাঁজরের হাড়’ নামে বেশ গল্প-কবিতাও লিখছেন। এমনকি এই নামে পুরো গ্রন্থও রচনা করতে দেখা গেছে। বলা হয়, নারীকে মাথার হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়নি যেন সে তার স্বামীর ওপর আধিপত্য বিস্তার না করে, আবার পায়ের হাড় থেকেও সৃষ্টি করা হয়নি যেন তাকে তুচ্ছ করা না হয়। বরং নারীকে বাঁ পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে তাকে বুকের কাছাকাছি ভালোবেসে রাখা যায়। কথাটা শুনতে যতটা আবেগী ও রোমান্টিক শোনায়, বাস্তবে ততটাই বিভ্রান্তিকর। কারণ কোরআন-হাদিসের কোথাও এ ধরনের বক্তব্য নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মুখ নিঃসৃত কোনো বাণীও নয় এটি। বরং গবেষক আলেমরা দাবি করছেন, এটি অন্যান্য কিছু ধর্মের পুরোনো কাহিনি থেকে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। অথচ মুসলমানদের জন্য জীবনবিধান এসেছে কোরআন ও সহিহ হাদিস থেকে, অন্য কোনো জাতির গল্পকাহিনি থেকে নয়। তাই এ প্রশ্নটির উত্তর জানা খুই গুরুত্বপূর্ণ যে, ‘নারী কি আসলেই স্বামীর বাঁ পাঁজরের হাড় থেকে তৈরি?’ চলুন, জেনে নিই শরিয়তের ভাষ্য— কোরআনে শুধু প্রথম মানব হজরত আদম (আ)-এর ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, একই ‘নফস’ থেকে বিবি হাওয়াকেও সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, তিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের একই ‘নফস’ থেকে। অতঃপর তা থেকে তার যুগল সৃষ্টি করেছেন। (সুরা যুমার : ৬) অন্যত্রে ইরশাদ হয়েছে, হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ‘নফস’ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দুজন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। (সুরা নিসা : ১) এই আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে মুফাসসিরগণ বলেন যে, ‘তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন’ বলে এখানে উদ্দেশ্য বিবি হাওয়া (আ.), যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে আদমের বাঁ পাঁজরের হাড় থেকে। তখন তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। জাগ্রত হয়ে যখন তাকে দেখলেন, তখন বিস্মিত হলেন এবং তাঁর প্রতি প্রীত হলেন। তিনিও আদম (আ.) এর প্রতি প্রীত হলেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির :  ২/২০৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন : খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৭৩১) প্রখ্যাত ইসলামী স্কলার শায়খ আহমাদুল্লাহর ভাষ্য, ‘হজরত হাওয়াকে (আ.) আদমের বাঁ পাঁজর থেকে তৈরি করা হয়েছে—এর মানে এই নয় যে, সকল স্ত্রীলোককে তার স্বামীর বাঁ পাঁজরের হাড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। একে তো এর পক্ষে কোনো দলিল নেই, দ্বিতীয়ত এটি যুক্তিহীন কথা। কারণ, যেসব মেয়ে বাচ্চা শিশুকালেই মারা গেছে বা বিয়ে ছাড়াই মারা গেছে, তাদের কার হাড় দিয়ে তৈরি করা হলো? তাদের তো স্বামীই ছিল না দুনিয়ায়। আর যেসব নারীর জীবনে একাধিক স্বামী এসেছে, তারা কোন স্বামীর পাঁজর থেকে সৃষ্টি হলো? সুতরাং স্বামীর পাঁজরের হাড় দিয়ে স্ত্রীদের তৈরি করা হয়েছে—এ দাবিটি ভুল।’ হাদিসে রাসুল (সা.) জানিয়েছেন, ‘তোমরা নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও, কারণ নারীকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, পাঁজরের মধ্যে উপরের হাড্ডি সবচেয়ে বেশি বাঁকা। যদি তা সোজা করতে চাও ভেঙে ফেলবে, ছেড়ে দিলেও তার বক্রতা যাবে না। কাজেই নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও (বোখারি : ৩৩৩১)।’ হাদিসটির ব্যাখ্যায় আহমাদুল্লাহ বলেন, এই হাদিসে নারীদের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টির কথা এসেছে ঠিক; কিন্তু এর মানে এই না যে, প্রত্যেক নারীকেই তার স্বামীর বাঁ পাঁজরের হাড় থেকে তৈরি করা হয়েছে। এখানে মূলত বোঝানো হয়েছে, নারীদের মূল উৎপত্তি বাঁ পাঁজরের হাড় থেকে। মুহাদ্দিসিনে কেরাম বলছেন, হাদিসে ‘বাঁ পাঁজরের হাড়’ এটি কেবলই একটি উপমা। এই উপমা নারীদের উপলব্ধি করার জন্য, উত্তমভাবে বোঝার জন্য। পাঁজরের হাড়ের গঠন বাঁকা প্রকৃতির। নারী জাতির চিন্তা-ভাবনাও পুরুষদের মতো নয়; বরং কিছুটা ভিন্ন ধরনের। তারা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ, কখনো অনেক কষ্ট পায়, আবার কখনো অনেক রাগ করে। তাই স্বামীদের উচিত নয়—স্ত্রীর কাছ থেকে সবকিছু নিখুঁত আশা করা। বরং উচিত হলো, তাদের ভুল ও সীমাবদ্ধতাগুলোকে না ধরা। তাদের সঙ্গে ভালো ও সহনশীল আচরণ করা। এটিই হাদিসের মূল কথা। ইন্দোনেশিয়ান আলেম ও দার্শনিক আবদুল মালিক করিম আমরুল্লাহ তার তাফসিরে উল্লেখ করেছেন, ‘বিবি হাওয়াকে আদমের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টির কাহিনি হিব্রু জাতিগোষ্ঠীর, বিশেষত ইহুদিদের তৈরি রূপকথা ছাড়া অন্য কিছু নয়। (তফসিরুল আযহার)  মুহাম্মদ আবদুহ-এর মতে তাফসিরের কিতাবে এই কাহিনি বাইবেলের পুরাতন নিয়ম থেকে সংগৃহীত গল্পমাত্র (আল আমালুল কামিলাহ)। মিশরীয় স্কলার রাশিদ রিদাও একই কথা বলেছেন।  সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, নারীরা স্বামীর বাঁ পাঁজরের হাড় থেকে তৈরি—এই ধারণাগুলো ভিত্তিহীন ইসরায়েলি বর্ণনা, যা মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করেছে। 
Read Entire Article