ইসলামী ফিকহ, ফতোয়া ও আইনের ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র ইমাম আবু হানিফা (রহ.)। তার মূল নাম নুমান ইবনে সাবিত। তিনি ৮০ হিজরিতে (৬৯৯ খ্রিষ্টাব্দ) খোরাসানের অন্তর্গত কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতামহের আসল মাতৃভূমি পারস্য হলেও তিনি ইসলামের সোনালি যুগে মুসলমান হন। তার পরিবার কুফায় স্থায়ীভাবে বসবাস করত, যা সে সময় ইসলামী জ্ঞানের অন্যতম কেন্দ্র ছিল। শৈশবেই তিনি কোরআন মুখস্থ করেন এবং কুফার বিখ্যাত বিদ্যাপীঠগুলোতে অধ্যয়ন শুরু করেন। তিনি মূলত ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান ছিলেন, কিন্তু একবার কুফার এক আলেম শেখ আমির আশ-শাবি (রহ.) তাকে ইসলামী জ্ঞানচর্চার দিকে মনোযোগী হতে বলেন। এরপর তিনি ইসলামী জ্ঞান অর্জনে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি কুফার শীর্ষস্থানীয় আলেমদের কাছে হাদিস, ফিকহ, ব্যাকরণ, যুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিশেষ করে হাম্মাদ ইবন আবু সুলায়মান (রহ.)-এর কাছে ১৮ বছর ফিকহ অধ্যয়ন করেন। এ ছাড়া মক্কা, মদিনা, বসরা, শামসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে জ্ঞানার্জন করেন এবং অনেক বিখ্যাত তাবিঈ ও সাহাবির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
ইমাম আবু হানিফার প্রধান শিক্ষক ছিলেন হাম্মাদ ইবন আবু সুলায়মান (রহ.)। এ ছাড়া তিনি আতা ইবন আবি রাবাহ, ইকরিমা (ইবন আব্বাসের দাস), নাফি (ইবন উমরের দাস), ইমাম জাফর আস-সাদিক (রহ.)-সহ বহু প্রখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্বের কাছে জ্ঞান আহরণ করেন। তার বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন—ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.); প্রথম হানাফি প্রধান বিচারপতি। ইমাম মুহাম্মাদ আশ-শাইবানি (রহ.); হানাফি ফিকহের অন্যতম প্রধান সংকলনকারী। ইমাম জুফর ইবন হাম্মাদ (রহ.); প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস। ইমাম জুফর ইবন হুজাইল (রহ.); বিশিষ্ট ফকিহ।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ফিকহের ক্ষেত্রে এক বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করেন, যা পরবর্তীকালে ফিকহে হানাফি নামে পরিচিত হয়। তার পদ্ধতি ছিল—১. কোরআন ও সুন্নাহ: ইসলামের প্রধান দুটি উৎস। ২. সাহাবিদের মতামত: সাহাবিদের বক্তব্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। ৩. কিয়াস (যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত): কোরআন-হাদিসের আলোকে নতুন সমস্যার সমাধান। ৪. ইস্তিহসান (সাধারণ কল্যাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত)। ৫. উরফ (প্রচলিত রীতি ও সংস্কৃতি)। এ পদ্ধতির মাধ্যমে হানাফি মাজহাব গঠিত হয়, যা বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইসলামী মাজহাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
আব্বাসীয় খলিফা আবু জাফর আল-মানসুর তাকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করতে বলেন, কিন্তু ইমাম আবু হানিফা তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তাকে কারারুদ্ধ করা হয় এবং বলা হয় যে, তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। ১৫০ হিজরিতে (৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দ) বাগদাদে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার জানাজা এত বিশাল হয়েছিল যে, দফায় দফায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে।
ইমাম আবু হানিফার ফিকহের ওপর ভিত্তি করেই হানাফি মাজহাব প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আজও মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে প্রচলিত। বিশেষ করে, উসমানীয় সাম্রাজ্য, মোগল ভারত, মধ্য এশিয়া, তুরস্ক, মিশর, সিরিয়া, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো অঞ্চলে হানাফি মাজহাব অনুসৃত হয়। যদিও ইমাম আবু হানিফা নিজে কোনো গ্রন্থ লেখেননি, তবে তার শিক্ষা ও মতামত ছাত্ররা লিপিবদ্ধ করেছেন। তার নামে কিছু সংকলন পাওয়া যায়, যেমন—১. আল-ফিকহুল আকবর (আকিদাবিষয়ক গ্রন্থ)। ২. আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম (জ্ঞান ও শিক্ষার্থীদের নীতিমালা)। ৩. কিতাবুল আছার (ফিকহি মাসআলার সংকলন)।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ইসলামী আইনের ইতিহাসে এক মহান ব্যক্তিত্ব। তিনি কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন, তা আজও লাখ লাখ মুসলমান অনুসরণ করছে।