২০১৮ সালে খুব কম বয়সে ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে অভিষেক। পরের বছর মানে ২০১৯-এর প্রিমিয়ার লিগে লিজেন্ডস অব রুপগঞ্জের হয়ে ৮০৭ রান করে রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। একই বছর জাতীয় দলে অভিষেক।
মাত্র ২০ বছর বয়সে অভিষেকে তার শুরুটা ছিল নজরকাড়া। মারকুটে ওপেনারের প্রতিমূর্তি মনে হচ্ছিল নাইম শেখকে। ২০১৯ সালের নভেম্বর (১০) ভারতের নাগপুরে ক্যারিয়ারের তিন নম্বর টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে মাত্র ৪৮ বলে ৮১ রানের হ্যারিক্যান ইনিংস খেলে শিরোনামে উঠে আসেন। যদিও সে রুদ্ররূপ তার থাকেনি বেশিদিন।
অল্প সময়ের মধ্যে নাইম শেখের ব্যাটের সেই ‘মার মার, কাট কাট’- ভাবটা কেটে যায়। সময়ের প্রবাহমানতায় অল্প কিছুদিন পরই তার ব্যাটের ধার কমতে শুরু করে। কেমন যেন আড়ষ্টতা নেমে আসে। হাত খুলে প্রতিপক্ষ বোলারদের শাসন করা বহুদুরে, স্বচ্ছন্দে রান করতেই কষ্ট হচ্ছিল।
তাই ২০২২ সালের আগস্টে টি-টোয়েন্টি থেকে বাদ পড়ে যান নাঈম শেখ। আর ২০২৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর খেলেছেন শেষ ওয়ানডে ম্যাচ। সব মিলিয়ে দেড় বছর ধরে লাল সবুজ জার্সি গায়ে চড়ানো হয় না এ বাঁ-হাতি ওপেনারের।
গত এক বছর প্রতিটি ঘরোয়া আসরেই দারুণ সফল ব্যাটার নাইম শেখ। এ বাঁ-হাতি ওপেনারের ব্যাট কথা বলছে নিয়মিতভাবে। তার ব্যাটে ধারাবাহিকভাবে রানের ফলগুধারাও বইছে।
২০২৩ সালের প্রিমিয়ার লিগে ৯৩২ রান করে ব্যাটারদের তালিকায় সবার ওপরে জায়গা করে নেন। এখানেই শেষ নয়। ৫০ ওভারের পাশাপাশি টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও নাইম শেখের ব্যাট সমান সচল। তার প্রমাণ ২০২৪ সালের বিপিএলে দেশি ও বিদেশি ব্যাটারদের পিছনে ফেলে টপ স্কোরার হলেন।
আর বিপিএলের আগে এনসিএল টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টেও সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী ছিলেন তিনি। এবার যে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ হচ্ছে, সেই ৫০ ওভারের আসরেও গাজী গ্রুপের অধিনায়ক ওপেনার এনামুল হক বিজয়ের পর ৮ ম্যাচে ৪৯১ রান করে দ্বিতীয় স্থানটি দখলে রেখেছেন নাইম শেখ।
শুধু ধারাবাহিকভাবে ভাল খেলে রান করাই নয়। নাইম শেখের ব্যাট চালনায়ও এসেছে পরিপক্কতা। আগের চেয়ে নিজের ব্যাটিং টেকনিক আর ব্যাটিং শৈলিটা হয়েছে আরও সাজানো-গোছানো। এখন শট খেলায় বেশ পরিপক্কতা এসেছে। আগের মত তেড়েফুঁড়ে সব বল মারতে না গিয়ে শট সিলেকশনে আরও সংযত হয়েছেন নাইম।
আলগা বলে অপেক্ষায় থাকছেন। সেটাকে সীমানার ওপারে পাঠাতেই বেশি সচেষ্ট মনে হচ্ছে এ বাঁ-হাতি ওপেনারকে। দায়িত্ববোধটাও বেড়েছে অনেক। চটকদার মারের চেয়ে দল জেতানোর তাগিদ জন্মেছে। আর তাই এবারের প্রিমিয়ার লিগে তার ব্যাট থেকে বেরিয়ে এসেছে বেশ কটি লম্বা ও ম্যাচ জেতানো ইনিংস। সব মিলিয়ে এক অন্য ও ভিন্ন নাইম শেখের দেখা মিলছে এখন।
হঠাৎ কিভাবে নিজেকে বদলে ফেললেন এ তরুণ? কার ছোঁয়ায় তার ব্যাটিংয়ের জাদুকরি পরিবর্তন? জাগো নিউজের সাথে একান্ত আলাপে সে অজানা গল্পই শুনিয়েছেন ফরিদপুর শহরের ছেলে মোহাম্মদ নাইম বা নাইম শেখ।
জাগে নিউজ: নতুন নাইম শেখের দেখা মিলেছে। এর পিছনের কাহিনী কী, কিভাবে নতুন নাইম শেখের দেখা মিলেছে? এর পিছনের গল্পটা বলবেন?
নাইম শেখ: আগে যেমন ছিলাম ওইরকমই আছি। স্কিলে অবশ্যই ইমপ্রুভ করেছি। তবে আমার কাছে মনে হয় সবচেয়ে বড় যেটা, মেন্টাল ইমপ্রুভমেন্ট হয়েছে। আমার মনে হয়, আমার মানসিকভাবে উন্নতি ঘটেছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটে ভাল খেলার অন্যতম পূর্বশর্তই হলো মেন্টাল ডেভেলপমেন্ট। সেটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আমি কিভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে চাই, সেটাই অনেক বেশি ম্যাটার করে। মেন্টাল ডেভেলপমেন্ট যে আমার আগে ছিল না, তা নয়। ছিল; কিন্তু আগে আমার বাস্তবায়ন বা প্রয়োগটা ভাল বা যথাযথ হতো না। বলতে পারেন আমার এক্সিকিউশনটা ঠিক ছিল না। কোনো উইকেটে কেমন খেলা উচিৎ, কেমন অ্যাপ্রোচ, অ্যাপ্লিকেশন হওয়া দরকার, উইকেট সম্পর্কে ধারনা, বোলার সম্পর্কে ধারনা, কাকে কিভাবে খেলা উচিৎ- সে সব সুক্ষ্ম বিষয়গুলো পয়েন্ট আউট করা ছিল না।
আমার কিভাবে বা কেমন শুরুটা হওয়া উচিৎ, কোন বোলারের বিপক্ষে অ্যাপ্রোচ ও অ্যাপ্লিকেশন কি হওয়া বাঞ্জনীয়- এসব বিষয় আমার ঠিক করা ছিল না। যে কারণে আমি প্রপার এক্সিকিউশন করতেও পারিনি। এখন আমার সব কিছু পয়েন্ট আউট করা আছে। আমি কখন কোন বোলারের বিপক্ষে কোন কন্ডিশনে খেলবো, কার সাথে কিভাবে খেলতে চাই, কার বিপক্ষে আমার অ্যাপ্রোচ, অ্যাপ্লিকেশন কেমন হবে, সব কিছু লিখা আছে।
জাগো নিউজ: আপনার ব্যাটিংয়ের টেকনিক্যাল ও স্কিলে কি কোন পরিবর্তন ঘটেছে? মানে কোন বড় ধরনের চেঞ্জ কি আসছে?
নাইম শেখ: আসছে।
জাগো নিউজ: সেটা কেমন?
নাইম শেখ: যেমন আগে আমি স্পিনে তত ভাল খেলতাম না। সবাই বলতো, আমি স্পিনে ততটা দক্ষ না; কিন্তু আমার মনে হতো না আমি স্পিনে দূর্বল। আমি রিয়ালাইজই করতাম না যে আমি স্পিন ভাল খেলি না; কিন্তু যখন আমার সব দুর্বলতাগুলো খাতা-কলমে বের করেছি। কোথায় কোন সমস্যা, কোন জায়গায় কি দুর্বলতা ও ঘাটতি, সেগুলো ঘেঁটে বের করতেই জানা হয়ে গেছে।
কোনো দিন কেউ বলতে পারেনি যে, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে আমি লেগ সাইডে ডমিনেট করে রান করতে পারছিলাম না। সব থেকে আমার দুর্বলতা বেরিয়েছে বাঁ-হাতি স্পিনারদের বিপক্ষে। আমি নিজের দুর্বলতা ঘেঁটে বের করে দেখি আমার সবচেয়ে দুর্বলতা হলো বাঁ-হাতি স্পিনারদের বিপক্ষে। লেফট আর্ম স্পিনারের বিপক্ষে আমি রান করতে পারছিলাম না। তাদের বিপক্ষে আমার স্ট্রাইকরেট সবচেয়ে কম।
যখন আমি এগুলো নিয়ে কাজ করেছি, তখন জানা হয়েছে এসব ঘাটতি ও কমতি। তারপর এগুলো নিয়ে দিনের পর দিন খুব সুক্ষ্মভাবে কাজ করা হয়েছে। সে সব দুর্বলতা ও ঘাটতি; কমতি নিরসনের চেষ্টা করা হয়েছে। আমার মাইন্ড ট্রেনার ছিল। আমার পার্সোনাল ট্রেনার নিয়োগ দিয়েছি।
জাগো নিউজ: এমন কেউ আছেন যারা আপনাকে হেল্প করেছে?
নাইম শেখ: স্পেশিফিক যদি বলতে চাই আমার স্কিলের ওপর ট্রাস্টটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বলতে পারেন মাইন্ড ট্রেনিং দিয়ে আসছে। ফ্যামিলি সাপোর্ট পেয়েছি। মাইন্ড ট্রেনার যিনি, হেল্প করেছেন প্রচুর। আমি যার তত্বাবধানে জিম করি তিনিও হেল্প করেছেন। অনেক খাবারে আমি অভ্যস্ত ছিলাম না। সেগুলোতে অভ্যস্ত হতে হয়েছে। সাবিত ভাই মাইন্ড সেট এ কাজ করেন। যে ভাই আমাকে জিম করান তিনিও অনেক কাজ করেছেন। ডায়েট চার্টও বদল করতে হয়েছে।
নিউট্রিশন পার্টে ওমর ভাই, জিমের রিয়াদ ভাই হেল্প মি এ লট। জিমের যত অ্যাক্টিবিটিস আছে সব করেছি। মাসল স্ট্রং করার কাজ করেছি। উনার সাথে আলাদা করে কাজ করেছি। কখনই তাই একজনকে ক্রেডিট দিতে পারবো না। কয়েকজনের কন্ট্রিবিউশনে আমার ইমপ্রুভমেন্ট হয়েছে।
জাগো নিউজ: আপনার টেকনিক ও স্কিল উন্নত করতে কেউ কি ভূমিকা রেখেছেন বা হেল্প করেছেন?
নাইম শেখ: অ্যাটাকিং মাইন্ড সেট নিয়ে শুরু করেছিলাম; কিন্তু মিডিয়ার চাপে খানিকটা অন্যরকম হয়ে যাাই। ক্রেডিট দিতে হয়, আমার ফরিদপুরের কোচ মোখলেসুর রহমান বাবলু স্যারকে। তিনি অনেক হেল্প করেছেন। সিনিয়ররা সব সময়ই হেল্প করেছেন।
বাউন্স ব্যাক করতে হলে স্কিল ওয়াইজ মোহামেডানের আনোয়ার ভাইয়ের (সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার ও মোহামেডানের সহযোগী কোচ) সঙ্গে শেষ তিন বছর কাজ করেছি। এছাড়া মিজানুর রহমান বাবুল স্যার, খালেদ মাহমুদ সুজন স্যারের কথা না বললেই নয়। তারা মেন্টালি হেল্প করেছেন।
আনোয়ার ভাইয়ের সাথে অনেক কাজ করেছি। ব্যক্তিগতভাবে ইউল্যাব মাঠ নিয়ে পার্সোনালি আমি অনেক অনুশীলন করেছি। প্রচুর টাইম কাটিয়েছি। টেকনিক্যালি বলেন, মেন্টালি বলেন আনোয়ার ভাই আমাকে অনেক বিষয়ে হেল্প করেছেন।
জাগো নিউজ: যে কোনো ঘরোয়া আসরে আপনার ব্যাটে নিয়মিত রান দেখা যাচ্ছে। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আপনিই টপ স্কোরার। সেটা কি শুধুই নিজেকে ঘষে মেজে তৈরি করার কারণে? নাকি এমন কোনো টার্গেট নিয়ে নামছেন যে আমাকে ভাল করতেই হবে, সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী হতেই হবে? এমন লক্ষ্য কি থাকছে?
নাইম শেখ: নাহ! সত্যি কথা বলতে কি নিজের ওপর আমি কখনই প্রেশার ক্রিয়েট করিনি। নিজেকে বাইন্ডিংস করে ফেলিনি যে এটা ওটা করতেই হবে। আমার প্রসেস আমি যতটা সম্ভব মেইনটেইন করেছি। প্রসেসটা যত ঠিক রেখে মেইনটেইন করা যায় এটা প্রসেস অনুযায়ী হয়েছে।
কিছু জিনিস আছে আমি প্ল্যান ওয়াইজ গিয়েছি। তবে আমাকে ওই টার্গেট অ্যাচিভ করতেই হবে, এমন চিন্তা করে আগাইনি। প্রত্যেকটা টুর্নামেন্ট বিপিএলের থেকে টি-টোয়েন্টির বড় প্লাটফর্ম আমাদের দেশে নেই। একইভাবে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের চেয়ে ৫০ ওভারে কমপিটিটিভ টুর্নামেন্টও আমাদের নেই।
সিরিয়াসলি না নেবার কোন অপশন ও অপরচুনিটি আমাদের নেই। নতুন যেটা হয়েছে সেটা হলো, এনসিএল টি-টোয়েন্টি, আমি সেখানেও মনোযোগ দেবার চেষ্টা করেছি। ডমিস্টিকে যত টুর্নামেন্টট আছে সবগুলোতে আমার একটাই টার্গেট থাকে, আমি আমার প্রসেস মেইনটেইন করবো। প্রসেসের বাইরে আমি কোথাও যেতে চাই না। কারণ ওয়ার্ল্ডে যত সাকসেসফুল ক্রিকেটার আছেন, সবাই প্রসেসে থেকেই সফল হয়েছেন। প্রসেসের বাইরে গিয়ে কেউ সফল হননি। আমি আল্লাহর রহমতে প্রসেসে থেকে সে চেষ্টাই করছি।
এআরবি/আইএইচএস