আশরাফুল ইসলাম আকাশ
কাঁচা-পাকা রাস্তা এখানেই শেষ। বাকি চার কিলোমিটার পথ পায়ে হাঁটার। গিরি, ঝিরি ও উঁচু-নিচু পাহাড়ি ঢাল। রোমাঞ্চকর এই পথের শেষে আছে ঠান্ডা এক ঝিরি। হাঁটু পানির এই ঝিরিই আমাদের নিয়ে যাবে মায়াবিনী হামহাম জলপ্রপাতে। গহীন বনে লুকিয়ে থাকা অপরূপ এই সৌন্দর্যে হারানোর আগে একটু পেছনে ফিরি।
ভোর সোয়া ৬টা। মাঝবয়সী সুপারভাইজারের কর্কশ কণ্ঠে ঘুম ভাঙলো। শরীরটা আড়মোড়া দিতেই কানে এলো শ্রীমঙ্গল পৌঁছেছি। ঘুম ঘুম চোখে ধীর পায়ে বাস থেকে নমে এলাম। কিছুক্ষণ পরেই এসে হাজির লাল রঙের জিপ গাড়ি। স্থানীয়দের কাছে এটি চাঁদের গাড়ি। আজ এই গাড়িই আমাদের গন্তব্য চিনিয়ে দেবে।
চাঁদের গাড়ি ছুটছে। শহর থেকে বেরিয়ে লাউয়াছড়া উদ্যানের কোল ঘেঁষে গাড়ি এগোচ্ছে নূরজাহান জাতীয় চা বাগানের দিকে। জনমানবহীন এক নির্জন টিলার কাছে জিপের ইঞ্জিন বন্ধ হলো। এখানেই সকালের নাস্তা বিরতি। পেটে খাবার পড়তেই শরীরটা চাঙা হলো। বন, আদিবাসি এলাকা, চা বাগান; সবমিলিয়ে যেন রূপকথার রাজ্য। আঁকা-বাঁকা সরু পথ ছেড়ে যাচ্ছি। দূর আকাশে সাদা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে সীমান্তের পাহাড়! এসব দেখতে দেখতে পৌঁছলাম কলাবন পাড়া। ট্রেকিং শেষে ফেরার পথে খাবারের বন্দোবস্ত করতে হলো। সবার মেন্যুতে থাকবে দেশি হাঁস, সাদা ভাত আর ডাল।
গাড়ি আর সামনে এগোবে না। ইটে পাড়া রাস্তার শেষ প্রান্তে আছি। ছোট্ট এক মাঠে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে সিএনজি, মাইক্রো আর চাঁদের গাড়ি। চারপাশে ছোট ছোট দলে বিভক্ত শিশুরা। ওদের হাতে বাঁশের লাঠি। গাড়ি থেকে নামতেই সবাই ঘিরে ধরলো। যে যার মতো নিজের লাঠিকে সেরা প্রমাণ করতে মরিয়া। শক্ত-পোক্ত দেখে ১০ টাকায় এক লাঠি হাতে নিলাম। শুরু হলো হামহাম ট্রেকিং।
চলছে বর্ষার ভরা মৌসুম। বাদল ঝরা এই দিনে পুরো যৌবন ফিরে পায় ঝরনা। সময়টা একদম পরিপক্ব। রাজকান্দির সংরক্ষিত বনের কুরমা বিটে পা রাখতেই বৃষ্টি নামলো। উঁচু উঁচু গাছের ডাল-পালা আর পাতার ছাতা অতিক্রম করে ঝিরি বৃষ্টির কণা মাটি পর্যন্ত পৌঁছলো না। গরম তাতে আরও বাড়লো। শরীর থেকে ঝরঝর করে ঘাম ঝরছে। হাঁপিয়ে উঠেছি, জোরে জোরে বুকের ওপর নিঃশ্বাস পড়ছে। জোঁক আর সাপের ভয় আছে, গাইডের কথায় শরীরে আগেই একটা মেডিসিন লাগিয়ে নিয়েছি।
যুগের পর যুগ ধরে এই বনকে আগলে রেখেছে জারুল, চিকরাশি আর কদম গাছগুলো। ট্রেকিংয়ের মাটির যে সরু পথ তার ধার ঘেঁষে উঠে গেছে ডুমুর আর বেত বাগান। এই বাগানের আড়ালে লুকিয়ে আছে অসংখ্য চশমাপরা হনুমান। পর্যটকের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীটি প্রকাশ্যে আসে না বললেই চলে।
পথ যত বাড়ছে পাখির কিচিরমিচির আর ঝিঁঝি পোকার ডাক ততই বাড়ছে। ছোট ছোট কয়েকটা ঝিরি, উঁচু-নিচু আর পিচ্ছিল পাহাড়ি ঢাল বেয়ে একটা বিশ্রামের জায়গা খুঁজে পেলাম। বাঁশের বেত দিয়ে কয়েকটা মাচাং, সাথে অস্থায়ী মুদি দোকান।
শসা, চা আর স্যালাইনের পানি পান করতেই দোকানি জব্বারের সাথে পরিচয়। কথায় কথায় তিনি জানালেন, এই পথ খুবই ভয়ানক। বিশেষ করে সন্ধ্যাবেলায়। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় আদিবাসীরা এ জঙ্গলে প্রবেশ করেন। উদ্দেশ্য মায়া হরিণ, চশমা পড়া হনুমান, শূকর কিংবা বন্যপ্রাণী শিকার করা। একসময় এখানে চিতা বাঘের দেখা মিলতো। সেসব কারণে তারা এখানে আসে। কোনো প্রাণী শিকারে ব্যর্থ হলে মুদি দোকানের সব ছিনতাই করে। পাহাড়িদের পেলে তুলে নিয়ে যায়। তার অভিজ্ঞতার বর্ণনায় শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
শরীরে শক্তি আসতেই আবার ট্রেকিং শুরু। গাছের শেকড়গুলো সিঁড়ি তৈরি করেছে। হামহাম যাওয়ার অধিকাংশ পথই বাঁশঝাড়ে ঘেরা। ডুলু, মির্তিঙ্গা আর কালীর মতো প্রাকৃতিক বাঁশগুলো এ জঙ্গলকে আরও ভুতুড়ে করে তুলেছে। তাতে রোমাঞ্চ আরও বাড়িয়েছে বৈকি! সরু উঁচু টিলা থেকে দুর্ঘটনাক্রমে পা পিছলে গেলেই শেষ! সোজা কয়েকশ ফুট খাদের নিচে, নেই কোনো উদ্ধারের সুযোগ।
পায়ের ছাপে বড় বড় সব গর্ত হয়েছে। এসব গর্তে পা রেখে আর বাঁশের লাঠিতে ভর করে কখনো ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে হচ্ছে, কখনো নিচে নেমে যাচ্ছেন পর্যটকেরা। শরীর আর চলছে না। পায়ের মাংসপেশীতে টান পড়েছে। এরই মধ্যে পিচ্ছিল পথে কয়েকবার আছাড়ও খেতে হয়েছে। পরে মেঘের আড়াল থেকে সূর্য বেরিয়েছে কি না, তা দেখা হয়নি। কারণ তখন তো গহীন বনে হাঁটছি।
বুনো জঙ্গলের মাঝে কয়েকটি মুদি দোকান বসেছে। ভরা মৌসুমে দোকানগুলো নিয়মিত খোলা পাওয়া যায়। ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি এসব দোকানে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। আরও স্পষ্ট করে বললে, পর্যটকদের শেষ দল না ফেরা পর্যন্ত দোকানগুলোতে বিকিকিনি হয়। শসা, জুস, স্যালাইন বিশেষ করে সুঘ্রাণের চা বিক্রি হয় বেশ। কিন্তু পাহাড়ি আর নির্জন স্থানে হওয়ায় কয়েক গুণ বেশি দামে খাবার কিনে খেতে খেতে হয় পর্যটকদের। চাইলেও অভিযোগের কোনো সুযোগ নেই। বর্ষা মৌসুম কেটে গেলে এসব দোকানের কোনো অস্তিত্বই থাকে না।
ঝিরি আর ছোট-বড় টিলা অতিক্রম করে শেষ মুদি দোকানে পৌঁছেছি। ট্রেকিংয়ের সবচেয়ে উঁচু জায়গা এটাই। মাচাংয়ে দুই পা এলিয়ে সীমান্তের ওপারে বিএসএফের টহল চৌকি দেখা যায়। তবে বুনো মশার যন্ত্রণায় টিকে থাকা দায়! এখান থেকে আনুমানিক ৬০০ মিটার খাঁড়া নামতে হবে। এটি বেশ চ্যালেঞ্জিং ও বিপজ্জনক। একে তো বৃষ্টিতে পুরো পথ পিচ্ছিল, তার সাথে বাঁশঝাড়। একটু অসতর্ক হলেই শেষ!
বাঁশের লাঠিতে ভর দিয়ে মনোযোগ ধরে ধীরে ধীরে পা বাড়াচ্ছি। একপর্যায়ে ঝিরির দেখা পেলাম। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। এই ঝিরিই হামহাম ঝরনায় নিয়ে যাবে। পুরো পথ ট্রেকিং করে ঘামে ডুব দিয়েছি। ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরটা যেই না ঝিরির বরফ ঠান্ডা পানি ছোঁয়া পেল, গায়ের রোমগুলো দাঁড়িয়ে গেলো। মুহূর্তেই দূর হলো সব ক্লান্তি। ঝরনা থেকে নেমে আসা টলটলা পানি পাথরের বাধা পেয়ে বাক বদল করছে। পানির কলকল শব্দে নিস্তব্ধ-নির্জন পাহাড়ে ঢাকা বনকে মাতাল করে তুলছে।
প্রায় ২ ঘণ্টা ৩৭ মিনিটের পথ অতিক্রম করে অবশেষে সেই বুনো সৌন্দর্যের সামনে। এ যেন সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৃষ্টি। ছবির মতো মোহনীয় আর মায়াবী এক জলপ্রপাত। ঝরনার গা বেয়ে নেমে আসছে দুধের মতো সাদা পানি। যা মুহূর্তেই মিলিয়ে যাচ্ছে ঝিরির সাথে। কী মায়াঘেরা এক জলপ্রপাত, হাজার বছরের পুরোনো পথের সেই জলধারা। মন আর দুই চোখ রূপকথার রাজ্যে নিয়ে যায়। তথ্য বলছে, আনুমানিক ১৪০-১৫০ ফুট উঁচু এই জলপ্রপাত। দুই ধাপের পাহাড়ি ঢাল বেয়ে ঝরনার পানি নেমে আসে। যা ঝিরিপথ ধরে পাথরকে ডিঙিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সঙ্গে সতেজ করছে কত-শত নাম না জানা গাছের কাণ্ডকে।
ঝুম বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টির ছোয়া পেয়ে ঝরনার যৌবন ফুলে ফেঁপে উঠলো। তীব্র গতিতে নেমে আসছে ঝরনার পানি। যা দেখার জন্য এতটা পথ পেরিয়ে এলাম, তাতে ক্লান্ত শরীরটাকে ভিজিয়ে নিলাম। ঝাপিয়ে ঝাপিয়ে মনকে বিষাদমুক্ত করে ফিরলাম জনপদে। কলাবন পাড়ায় ঢুকে কূপের পানিতে গোসল সেরে নিলো সবাই। ঝাল ঝাল হাঁসের মাংসের সাথে গরম ভাত। পেটপুরে খেয়ে নয়ন মিয়ার চাঁদের গাড়ি ছুটলো কমলগঞ্জে।
সতর্কতা
হামহাম ঝরনার পুরো পথ খুবই পিচ্ছিল। এজন্য ট্রেকিং জুতা জোড়া সঙ্গে নেবেন। পুরো পথে সাপ আর জোঁকের ভয় আছে। সেজন্য লবণ কিংবা কোনো মেডিসিন সঙ্গে রাখলে ভালো। শরীরকে যত মুক্ত রাখা যায়, ততই সুবিধা। ভ্রমণ গাইডের পরামর্শে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে। দলবদ্ধভাবে ভ্রমণ করলে বেশি সুবিধা। এখানে থাকার কোনো বন্দোবস্ত নেই। তাই শ্রীমঙ্গল ফিরে পছন্দমতো হোটেলে থাকতে পারবেন।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলের যে কোনো দূরপাল্লার চেয়ার কিংবা এসি কোচের টিকিট কাটতে হবে। সার্ভিসের মানভেদে জনপ্রতি ৫৫০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে টিকিট কেটে নিতে হবে। শ্রীমঙ্গলে নামার পর চাঁদের গাড়ি কিংবা সিএনজি যোগে যেতে পারবেন। শ্রীমঙ্গল থেকে কলাবন পাড়া দেড় ঘণ্টার পথ। ভ্রমণের কয়েকদিন আগে চাঁদের গাড়ি রিজার্ভ করলে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারবেন। এসব গাড়ি ৪-৫ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। হামহামে যেতে গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক। স্থানীয়দের ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকায় ভাড়া করা যায়।
এসইউ/এএসএম