হেমেডটির নিয়ন্ত্রণে আরও ভয়াবহ দুর্ভোগের মুখোমুখি হবে সুদান?

7 hours ago 5

সুদানজুড়ে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান সংঘাতে দেড় লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশে। প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। সুদানের আধাসামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) এর প্রকৃতি সম্পর্কে যদি কারো সন্দেহ থেকে যায় তবে গত ২৭ অক্টোবরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সে সময় তারা এল ফাশের শহর দখল করেছে এবং ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।

১৮ মাস ধরে অবরোধের পর আরএসএফ যোদ্ধারা পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চল দারফুরে সেনাবাহিনীর হাতে থাকা বৃহত্তম শহরটি দখল করে। তারা সেখানে ভয়াবহ নৃশংসতা চালিয়েছে এবং গর্বের সঙ্গে তাদের এসব কর্মকাণ্ডের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছে। সেখানে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে আরএসএফ, যার মধ্যে প্রায় ৪৬০ জন রোগী এবং এল-ফাশেরের প্রসূতি হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা কর্মীও রয়েছেন।

ওই অভ্যুত্থানের পেছনে মূলত যে দুইজন ব্যক্তি ছিলেন, তারাই সুদানে চলমান সংঘাতের পেছনে রয়েছেন। এরা হলেন- জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো। জেনারেল আল-বুরহান সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এবং সে কারণে তিনিই দেশটির প্রেসিডেন্ট।

অন্যদিকে দেশটির উপ-নেতা জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো কুখ্যাত আধা-সামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা আরএসএফের কমান্ডার। তিনি হেমেডটি নামেই বেশি পরিচিত। তিনি এল ফাশেরের ঘটনাকে গুরুত্বহীন বলে অভিহিত করেছেন এবং তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

অল্প কিছুদিন আগেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল। সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতা থেকে সরাতে তারা দুজন একসাথে কাজ করেছেন। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

আরএসএফ যোদ্ধা কারা?
এই আধা-সামরিক বাহিনীটি গঠিত হয় ২০১৩ সালে, যাদের নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে অনেক বিতর্ক রয়েছে। এই বাহিনীর মূলে রয়েছে জানজাওয়িদ মিলিশিয়া গ্রুপ যারা দাফুরের বিদ্রোহীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছে। এই গ্রুপের নেতা ছিলেন জেনারেল দাগালো।

আন্তর্জাতিক নিন্দা ও সমালোচনা সত্ত্বেও ওমর আল-বশির এই গ্রুপটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি আধা-সামরিক বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দেন, যার নামকরণ করা হয় বর্ডার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটস।

পরে এই গ্রুপটির সদস্যরা সুদানের গোয়েন্দা বিভাগের অংশ হয়ে ওঠে। আরও কয়েক বছর পর ওমর আল-বশির আরএসএফ বাহিনীটি গঠন করেন। তিনি নিজে এই বাহিনীর কার্যক্রম তদারকি করলেও এর প্রধান ছিলেন জেনারেল দাগালো।

এই দাগালো পরে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। আল-বশিরকে উৎখাতের পর সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন সরকারে তিনি উপ-প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

জেনারেল দাগালো পরে আরএসএফকে একটি শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলেন। এর মধ্য দিয়ে খুব দ্রুত তার ক্ষমতার উত্থান ঘটতে শুরু করে। আরএসএফ বাহিনী ইয়েমেন ও লিবিয়ার সংঘাতেও জড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয় সুদানের বেশ কয়েকটি সোনার খনিতেও তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

এই বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও অভিযোগ উঠেছে। তার মধ্যে রয়েছে ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলাকালে ১২০ জনেরও বেশি প্রতিবাদকারীকে হত্যা করা।

দেশটির সেনাবাহিনীর বাইরে এরকম শক্তিশালী একটি বাহিনীর উপস্থিতিকেও সুদানের অস্থিতিশীলতার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। চলতি বছরের জুনের শুরুতে আরএসএফ সুদানের সীমান্তের লিবিয়া ও মিশর সংলগ্ন অঞ্চল দখল করে।

এরপর অক্টোবরের শেষদিকে এল-ফাশের অঞ্চলের দখল নেওয়ার মাধ্যমে দারফুরের প্রায় শতভাগ ও পার্শ্ববর্তী কোর্দোফান অঞ্চলের সিংহভাগের ওপর দখল প্রতিষ্ঠা করে।

দারফুরের নতুন সুলতান 
হেমেডটি এখন দারফুর এবং পার্শ্ববর্তী কর্ডোফান অঞ্চলের কিছু অংশ তার নিজস্ব রাজ্যের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কার্যত দেশের পুরো পশ্চিম অংশ নিয়ন্ত্রণ করছেন। সুদানে দুই বছরের গৃহযুদ্ধের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে তার ভূমিকা রয়েছে, যা বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুদানে হতাহতের সংখ্যা যাচাই করা সম্ভব হয়নি তবে দেড় লাখ বা তারও বেশি মানুষ এরই মধ্যে নিহত হয়ে থাকতে পারে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা গেছে। হেমেডটির নিয়ন্ত্রণে থাকলে সুদান সম্ভবত আরও ভয়াবহ দুর্ভোগের মুখোমুখি হবে।

হেমেডটি সম্পর্কে বেশি কিছু জানা সম্ভব হয়নি। তার বয়স এখন প্রায় ৫০ বছর। তবে তার জন্মস্থান সম্পর্কে কেউ সঠিক তথ্য জানাতে পারেনি। তার পরিবার সুদান এবং চাদের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের আরবি-ভাষী রাইসিগাট জাতিগত গোষ্ঠীর অংশ। হেমেডটি দক্ষিণ দারফুরের স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। তবে তার তরুণ বয়সের বেশিরভাগ সময় তিনি উট ব্যবসায়ী বা উট-চোর হিসেবে কাটিয়েছেন বলে জানা যায়।

২০০৩ সালে খার্তুমে কেন্দ্রীয় সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে দারফুরে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। বিদ্রোহ দমনের জন্য সরকার বেশির ভাগই আরব মিলিশিয়াদের নিয়োগ করে আরএসএফ-এর অগ্রদূত জানজাউইদ গঠন করে। হেমেডটির চাচা জুমা দাগালো ছিলেন সেই মিলিশিয়াদের একজন এবং সম্ভবত তার ভাগ্নেকেও তিনি নিয়োগ করেছিলেন।

জানজাউইদরা মুসলিম কিন্তু অ-আরব ফার এবং মাসালিত (অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে) বসবাসকারী গ্রামগুলোতে গণহত্যা চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির এবং স্থানীয় জানজাউইদ কমান্ডারদের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং অন্যান্য অপরাধের অভিযোগ জারি করে। গত মাসে তাদের একজন আলী কুশাইবকে যুদ্ধাপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। হেমেডটির নিজস্ব ইউনিটকে ২০০৪ সালের নভেম্বরে আদওয়া গ্রাম ধ্বংস করার জন্য আফ্রিকান ইউনিয়ন অভিযুক্ত করে। সেখানে ১২৬ জনকে হত্যা করা হয় যার মধ্যে ৩৬ জন শিশু ছিল।

হেমেডটি জানজাউইদের রক্তাক্ত কার্যক্রমে পারদর্শী ছিলেন এবং তিনি পরবর্তীতে একজন আমির এবং সিনিয়র কমান্ডার হন। তিনি তার সমবয়সীদের চেয়ে ভিন্ন। হেমাডটি বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী বলে জানা যায়। অনেকেই তাকে দারফুরের নতুন সুলতান বলে থাকেন। 

তার উত্থান এবং আরএসএফ-এর অর্থায়নের মাধ্যমে হেমেডটি দারফুরের বৃহত্তম সোনার খনির নিয়ন্ত্রণ দখল করেন। পরবর্তীতে তার পরিবার একটি বিস্তৃত আন্তর্জাতিক ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। ২০১৯ সালে একটি গণবিপ্লবের সময় তিনি যখন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তখন তার সোনার সাম্রাজ্য এবং আরএসএফের সহিংস হুমকি তাকে সুদানের ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে উঠতে সহায়তা করে।

হেমেডটির সঙ্গে যারা যোগাযোগ করেছেন তারা তাকে সর্বোপরি একজন বাস্তববাদী হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
বিচক্ষণ হেমেডটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক মিত্রও গড়ে তুলেছেন। বিপ্লবের আগে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত হুথিদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সুদানের সেনাবাহিনীকে সৈন্য পাঠাতে বলেছিল। সে সময় তিনি একটি সুযোগ খুঁজে পেয়েছিলেন।

হেমেডটি ইয়েমেন যুদ্ধের জন্য ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে আরএসএফ যোদ্ধাদের আলাদাভাবে সরবরাহ করার জন্য একটি চুক্তি করেছিলেন। অনেক সূত্র যুক্তি দেয় যে, সংযুক্ত আরব আমিরাত এখনও আরএসএফের প্রধান সামরিক সমর্থক, যদিও সংযুক্ত আরব আমিরাত দৃঢ়ভাবে এটি অস্বীকার করে।

২০১৯ সালে বিপ্লবের পর, তিনি কানাডার একটি জনসংযোগ সংস্থাকে ৬ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিলেন যাতে বিদেশে তার ভাবমূর্তি পরিবর্তন করা যায়। তিনি ‘গণতন্ত্রের’ জন্য লড়াই করছেন বলে দাবি করেন এবং তার শত্রুদের ‘উগ্র ইসলামপন্থি’ হিসাবে চিহ্নিত করেন। ২০২২ সালে রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে হেমেডটি সে সময় মস্কোতে রুশ সরকারের সাথে আলোচনা করছিলেন।

আজ তিনি একজন নীতিহীন, স্বাধীনচেতা যুদ্ধবাজ, যার পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে আরএসএফ। প্রায় এক লাখ সৈন্য, প্রচুর অর্থ এবং বিদেশে অত্যন্ত কার্যকর বন্ধু নিয়ে আরও ক্ষমতালোভী হয়ে উঠেছেন হেমেডটি। এদিকে গত ৬ নভেম্বর আরএসএফ বলেছে যে, তারা মানবিক যুদ্ধবিরতির জন্য আমেরিকার নেতৃত্বে একটি প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে এবং সংঘাতের অবসান ঘটাতে আলোচনার জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু পরের দিন স্থানীয় গণমাধ্যম খার্তুমের কাছে বিস্ফোরণের খবর প্রকাশ করে। যদি এটি হেমেডটি আরেকটি কৌশল হয়, তাহলে সুদানের জনগণকেই এর পরিণতি ভোগ করতে হবে।

সূত্র: বিবিসি, দ্য ইকোনমিস্ট

টিটিএন

Read Entire Article