১৫০ টাকায় মেলে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মহিষের দই
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে মহিষের দুধের দইয়ের জন্য দেশের একমাত্র উপজেলা জামালপুরের বকশীগঞ্জের নাম এখন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বকশীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের নঈম মিয়ার হাটের নামটি প্রথমে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে দীর্ঘদিন ধরে বিক্রি হয়ে আসছে মহিষের দুধ দিয়ে তৈরি সুস্বাদু দই। যদিও বকশীগঞ্জ পৌর শহরের বাজারেও এই দই নিয়মিত পাওয়া যায়।
জানা গেছে, উপজেলার এসব অঞ্চলে কৃষক কয়েক পুরুষ ধরে মহিষের দুধের দই বিক্রি করে আসছেন। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি কেমিক্যালমুক্ত মহিষের দুধের দই স্থানীয়দের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। বকশীগঞ্জ উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা নিম্নাঞ্চল, বিভিন্ন গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠ আর খাল-বিলে চোখে পড়ে সারি সারি মহিষের পাল। মহিষ পালন তুলনামূলক সহজ হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ গরুর বদলে মহিষ পালন করে থাকেন।
সরেজমিন দেখা যায়, গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির গোয়ালেই মহিষ রয়েছে। কয়েক পুরুষ ধরে এখানকার মানুষ কৃষিকাজের পাশাপাশি মহিষের দুধ দিয়ে তৈরি দই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মহিষের দুধ প্রচুর ঘন হওয়ায় বাজারে বিক্রি করে আশানুরূপ দাম মেলে না; কিন্তু মহিষের দুধে পরিমাণে বেশি ননি এবং ঘনত্ব থাকায় ভালোমানের দই তৈরি হয়, আবার বাজারে এই দইয়ের চাহিদাও বেশি। বাজারে পাওয়া গরুর দুধের দই তৈরিতে অর্থ এবং সময় দুটিই বেশি ব্যয় হয়।
গরুর দুধ দিয়ে দই তৈরির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বেশ জটিল। কিন্তু মহিষের দুধ দিয়ে দই তৈরির প্রক্রিয়াটি বেশ সহজ, কেমিক্যালমুক্ত এবং সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। কৃষক দুধ সংগ্রহের আগে মহিষকে ভালো করে পানিতে গোসল করিয়ে নেন, তারপর মা মহিষ থেকে দুধ দোহানো হয়।
দুধ সংগ্রহের পর সেটি বেশ গরম থাকে, তাই ঠান্ডা করতে দুধের পাত্রটি কিছু সময়ের জন্য ফ্যানের নিচে অথবা ফ্রিজে রেখে দেওয়া হয়। এর আগে দই জমানোর জন্য যে বিশেষ মাটির হাঁড়ি ব্যবহার করা হয়, সেই মাটির হাঁড়ির ভিতরটা আগুনে ভালোভাবে পুড়িয়ে নেয়। পরে সেই হাঁড়িতে ঠান্ডা দুধ ঢেলে তিন দিন সেই অবস্থায় ঢেকে রাখা হয়, আগুন দিয়ে জ্বাল করানো বা সাচ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, মহিষের দুধে প্রচুর ক্রিম থাকায় এর মধ্যেই দই জমে যায়। দইয়ের গুণগতমান ভালো রাখতে অনেকেই আবার সেটি ফ্রিজেও রেখে দেন। দই তৈরির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে স্থানীয় নঈম মিয়ার হাটে কিংবা বকশীগঞ্জ হাটে বিক্রি হয় এই দই।
নঈম মিয়ার হাট বসে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার আর বকশীগঞ্জ পৌর শহরের হাট বসে প্রতি রোববার ও বৃহস্পতিবার। সারা বছর প্রতি কেজি দই বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা দরে। তবে দুই ঈদে এই দই বিক্রি হয় ২৬০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে। কয়েক পুরুষ ধরে এই অঞ্চলের কৃষক তথা ঘোষদের হাতে তৈরি এই মহিষের দুধের সুস্বাদু দই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
বকশীগঞ্জের মেরুর চরের মহিষ পালক আব্দুল মজিদ জানান, বিস্তীর্ণ চর এলাকায় সহজেই মহিষ পালন করা যায়। মহিষ পালন করে ও মহিষের দুধের দই বিক্রি করে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা ভালো বলে জানান তারা। কাদাপানির মহিষ পালন করা গরু পালনের চেয়ে অনেক বেশি সহজ।
একই উপজেলার বগারচর ইউনিয়নের কৃষক মুছা মিয়া বলেন, দুধের চেয়ে দই-এ লাভ বেশি হওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকরা দই প্রস্তুত করে থাকে। অন্য যে কোনো কৃষিকাজের চেয়ে মহিষ পালন লাভজনক ও মাঠে প্রচুর ঘাস থাকায় পালা সহজ।
বকশীগঞ্জ উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল লতিফ লায়ন বলেন, মহিষের দুধের দই এ অঞ্চলের শত বছরের ঐতিহ্যের অংশ। আগে এলাকার বাইরে তেমন পরিচিত ছিল না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে অনেক তথ্য এবং ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় দেশ ছাড়িয়ে এখন বিদেশে বকশীগঞ্জের মহিষের দুধের দইয়ের নাম ছড়িয়ে পড়েছে। এ দইয়ের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রয়োজন। জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির জন্য রাষ্ট্র পদক্ষেপ নেবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।
এ বিষয়ে বকশীগঞ্জ উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ জহুরুল হোসেন বলেন, মহিষের দই এ অঞ্চলের ঐতিহ্য। বংশপরম্পরায় এ অঞ্চলের মানুষ মহিষের দই তৈরি করে আসছে। এখানের প্রস্তুতকৃত মহিষের দই অত্যন্ত সুস্বাদু ও উন্নত। এ মহিষের দই ব্র্যান্ডিং করার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে বলে জানান তিনি।