৩৭ বছরের পুরোনো জাহাজে তেল পরিবহন করতো বিএসসি
চট্টগ্রাম বন্দরের বহিনোঙরে ৩৭ বছরের পুরনো দুটি জাহাজ তেল পরিবহনে ব্যবহৃত হত। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন বহির্নোঙরের বড় জাহাজ থেকে তেল খালাসের কাজে ‘বাংলার জ্যোতি’ ও ‘বাংলার সৌরভ’ কে ব্যবহার করত বিএসসি।
১৯৮৮ সালে তৈরি হওয়া বাংলার জ্যোতি এবং বাংলার সৌরভ জাহাজের প্রতিটির ওজন ৩ হাজার ৭৮৭ টন। গত অক্টোবরে তেলবাহী ওই দুই জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে নান জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে। উদ্বেগ দেখা দেয় চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তার।
বিএসসি ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক আশঙ্কা করেছিলেন দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলতেই এই নাশকতা চালানো হয়েছে। বিএসসি ছাড়াও বন্দরের অন্যান্য স্টেকহোল্ডার ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তাদের ভাষ্য, বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের পর্যন্ত সুসজ্জিত ফায়ার স্টেশন নেই। এতে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভয়াবহ বিপর্যয়ের ঝুঁকি বেড়েছে। কর্ণফুলী, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) ও বন্দর ফায়ার স্টেশনের দমকলকর্মীদের এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলা করতে হয়। এ ছাড়া তারা চট্টগ্রামে জ্বালানি তেল পরিবহন ও মজুতের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন খাতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের মতো শিল্প খাতগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, এই অস্থিরতাগুলো পরিকল্পিতভাবে সংঘটিত হচ্ছে।
তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান কাটিয়ে বিএসসির দুই জাহাজে আগুন লাগার ঘটনা নাশকতা নয় উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে আগুন লাগার তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটা কোনো নাশকতা নয়। নাবিক ও বিএসসির দায়িত্বরত ব্যক্তিদের অদক্ষতা, অসতর্কতা ও অবহেলার কারণে জাহাজে আগুন ধরেছে।
দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ছিল ক্যাপ্টেন নিকোলাস জাহাজের নাবিকদের অসতর্কতা ও অবহেলা। সবার আগে এ জাহাজেই আগুন লেগেছিল। গভীর সাগরের কুতুবদিয়ায় এলপিজি সুফিয়া ও ক্যাপটেইন নিকোলাস পাশাপাশি একটি আরেকটির সঙ্গে রশি দিয়ে বাঁধা ছিল। সামনের অংশে পাঁচটি ও পেছনের অংশে পাঁচটি রশি ছিল। হোস পাইপ দিয়ে নিকোলাস থেকে সুফিয়ায় এলপিজি স্থানান্তর করা হচ্ছিল। কিন্তু রাত ১২টা ১০ মিনিটে সামনের অংশের পাঁচটির মধ্যে একটি রশি প্রথমে ছিঁড়ে যায়। পরবর্তী ২০ মিনিটে বাকি চারটি রশি ছিঁড়ে যায়। এতে করে জাহাজ দুটি দূরে সরে যেতে থাকে। টান পড়ে হোস পাইপে। একপর্যায়ে হোস পাইপ ছিঁড়ে গিয়ে গ্যাস লিকেজ হতে শুরু করে। লিকেজ হওয়া এলপিজি গ্যাসে রূপান্তরিত হতে আরও প্রায় পাঁচ মিনিট সময় পায়। ১২টা ২৫ মিনিটে আগুনের সূত্রপাত হয়। তখন পেছনের দিকের পাঁচটি রশিতে আগুন লেগে সুফিয়ায় ছড়িয়ে যায়। আর হোস পাইপ থেকে আগুন ধরে যায় নিকোলাসে। সুফিয়ার নাবিকরা নিকোলাসের ক্যাপ্টেনকে দফায় দফায় জানানোর চেষ্টা করলেও তার সাড়া মেলেনি। ফলে আগুনের মাত্রা বেড়ে যায়। পরে নিকোলাসের আগুন নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা দিয়ে নেভানো গেলেও সুফিয়া জাহাজে ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্ত আগুন জ্বলে।
তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার) কমোডর এম ফজলার অন্য সদস্যদের নিয়ে কুতুবদিয়ায় পুড়ে যাওয়ায় ‘এলপিজি সোফিয়া’ জাহাজটি তিন দফা পরিদর্শন করেছেন। ১২ অক্টোবর মধ্যরাতে বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়ায় মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) ‘ক্যাপ্টেন নিকোলাস’ থেকে লাইটার জাহাজ ‘এলপিজি সোফিয়া’য় এলপিজি স্থানান্তরের সময় এই অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র ও সচিব ওমর ফারুক গণমাধ্যমকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডে কারণ অনুসন্ধানে মানবসৃষ্ট কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। এখানে জাহাজে কর্তব্যরতদের অসতর্কতা ছিল বলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। যদি তারা রাত্রিকালীন ডিউটিতে আরও সজাগ ও সতর্ক থাকতেন, তাহলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কিছুটা হলেও এড়ানো যেত।