একে একে কেটে গেছে ৩৯ বছর। এর মধ্যে হরেন্দ্রনাথ চন্দ্র (হরেন) জেল খেটেছেন কয়েকবছর। এরপর জেল থেকে মুক্তি মিললেও বয়ে বেড়াতে হচ্ছিল ব্যাংকের টাকা তছরুপের দায়। বছরের পর বছর ঘুরেছেন আদালতের দ্বারে। অবশেষে ঘটনার ৩৯ বছর পর প্রমাণ হলো হরেন ব্যাংকের টাকা তছরুপ করেননি।
কুষ্টিয়ার খোকসার হেলালপুর গ্রামের বাসিন্দা হরেন্দ্রনাথ চন্দ্র ১৯৭৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ক্যাশিয়ার কাম ক্লার্ক পদে সোনালী ব্যাংকে ঢাকার এক শাখায় যোগদান করেন। তিন বছর পর পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র ক্যাশিয়ার কাম ক্লার্ক হন।
দায়িত্ব পালনকালে রেমিট্যান্স সংক্রান্ত ১৬ লাখ ১৬ হাজার ১০০ টাকা যাত্রাবাড়ী শাখা থেকে লোকাল অফিসে স্থানান্তর করতে সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তার সিল-স্বাক্ষরসহ লিখিতভাবে সমুদয় অর্থ বুঝে নেন। এর কিছুদিন পর ১৯৮৫ সালে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে ওই টাকা পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এরপর ওই টাকার জন্য কর্মকর্তাদের করা হয় সাময়িক বরখাস্ত, হয় মামলা। হরেন্দ্রনাথ চন্দ্রসহ ৯ জনের হয় জেল-জরিমানা। এরপর কেটে গেছে প্রায় চার দশক। এরই মধ্যে ওই নয়জনের আটজন মারা গেছেন, বেঁচে আছেন শুধু হরেন্দ্রনাথ। তবে ৮০ বছর বয়সী এ বৃদ্ধ মৃত্যুর আগেই প্রমাণ করে গেলেন তিনি সোনালী ব্যাংকের টাকা তছরুপ করেননি।
১৯৮৫ সালে ১৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ব্যাংক কর্মকর্তা থাকার সময় নয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই মামলায় দীর্ঘ ৩৯ বছর আইনি লড়াই শেষে ভারমুক্ত হলেন হরেন্দ্রনাথ চন্দ্র। সব আদালতের মতো আপিল বিভাগের রায়ও তার পক্ষে গেছে।
মামলার রায়ে হরেন্দ্রনাথকে ২০ লাখ টাকা দিতে সোনালী ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বিগত প্রায় চার দশকে মামলার খরচ হিসেবে তাকে এ টাকা দিতে বলা হয়েছে।
আদালতে হরেন্দ্রনাথ চন্দ্রের পক্ষে (বিনামূল্যে সরকারি আইনি সেবায় নিযুক্ত) শুনানি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক। সোনালী ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আবদুস সোবহান।
এ বিষয়ে ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ৮০ বছর বয়সী হরেন্দ্রনাথ আজ ভারমুক্ত হলেন। ১৯৮৫ সালের এক ঘটনায় তিনি জেলও খেটেছেন। এরপর সব আদালতেই তিনি জয়ী হয়েছেন। তবে মামলার প্রতিটি ধাপেই সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আপিল করে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সর্বশেষ আপিলেও জয়ী হয়েছেন হরেন্দ্রনাথ।
- আরও পড়ুন
- চাকরি হারানো হরেনকে ২০ লাখ টাকা দিতে সোনালী ব্যাংককে নির্দেশ
- অর্থপাচার মামলায় তারেক রহমানের ৭ বছরের দণ্ড স্থগিত
তিনি বলেন, আমাদের আর্জিতে আদালত তিন মাসের মধ্যে ২০ লাখ টাকা (মামলা চালাতে যে খরচ হয়েছে) দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এই আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
আইনজীবীর তথ্যমতে, কুষ্টিয়ার খোকসার হেলালপুর গ্রামের বাসিন্দা হরেন্দ্রনাথ চন্দ্র। বিএ পাস করে ১৯৭৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ক্যাশিয়ার কাম ক্লার্ক পদে সোনালী ব্যাংকে ঢাকার এক শাখায় যোগদান করেন। তিন বছর পর পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র ক্যাশিয়ার কাম ক্লার্ক হন।
এরপর তাকে যাত্রাবাড়ী শাখায় বদলি করা হয়। চাকরিরত অবস্থায় রেমিট্যান্স সংক্রান্ত ১৬ লাখ ১৬ হাজার ১০০ টাকা যাত্রাবাড়ী শাখা থেকে লোকাল অফিসে স্থানান্তর করা হয়। সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা সিল-স্বাক্ষরসহ লিখিতভাবে সমুদয় অর্থ বুঝে নেন। এর কিছুদিন পর ১৯৮৫ সালে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে ওই টাকা পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
তহবিল তছরুপের অভিযোগে ১৯৮৫ সালের শেষের দিকে হরেন্দ্রনাথসহ নয়জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পরে ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে তাদের সবাইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এরপর গ্রাহকের টাকা জমা না দেওয়ায় অপর এক মামলায় ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে সাত বছর কারাদণ্ড দেন আদালত। পাশাপাশি অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে হরেন্দ্রনাথ জেল থেকে বের হন।
এর আগে ১৯৮৫ সালের ২৯ জুলাই হরেন্দ্রনাথসহ নয়জনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ঢাকার বিশেষ আদালতে ফৌজদারি মামলা করে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো। বিচারে ১৯৮৬ সালের ১৫ নভেম্বর বেকসুর খালাস পান হরেন্দ্রনাথসহ সবাই।
মামলায় পরাজিত হয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১৯৮৮ সালে হরেন্দ্রনাথসহ সবার বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। ওই মামলার রায়ে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে সমুদয় অর্থ ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। এর বিরুদ্ধে আবেদন (মিস কেস) করেন হরেন্দ্রনাথ। ১৯৯২ সালের ১৯ আগস্ট ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালত আপিল গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে বিচারিক আদালতের আদেশ বাতিল করেন। এরপর ওই রায়ের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংক ২০১৯ সালে হাইকোর্টে আপিল আবেদন করে। ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট এ আপিল খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। এরই মধ্যে এ মামলার অন্যসব আসামি বিভিন্ন সময়ে মারা গেছেন, একমাত্র বেঁচে আছেন হরেন্দ্রনাথ চন্দ্র।
গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। গতকাল সোমবার সেটি খারিজ হয়ে যায়।
এফএইচ/কেএসআর/এএসএম