কৃষকরা কোনোদিন ব্যাংকে আসেননি, ঋণের জন্য আবেদনও করেননি। তারপরও তাদের নামে সুদসহ ঋণ পরিশোধের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কৃষকদের কেউ কেউ ৫০-৮৫ হাজার টাকা পরিশোধের নোটিশ পেয়েছেন। এভাবে জনতা ব্যাংক ভৈরব বাজার শাখায় ৮১ লাখ টাকা কৃষিঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। ঋণ দেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
এসময়ে জনতা ব্যাংকের ভৈরব বাজার শাখার ম্যানেজার ছিলেন তুলিপ কুমার সাহা এবং ঋণ বিতরণের মাঠ পর্যায়ের দায়িত্বে ছিলেন ব্যাংকের লোন অফিসার রবিন্দ্র চন্দ্র সরকার। তবে ঘটনাটি ধরা পড়ে চলতি বছরের জুলাই মাসে। এরপরই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ শাখা ম্যানেজার তুলিপ কুমার সাহা ও ব্যাংকের মাঠ কর্মী রবিন্দ্র চন্দ্র সরকারকে সাময়িক বরখাস্ত করে।
ঋণ জালিয়াতির ঘটনাটি ঘটেছে ভৈরব উপজেলার শিমুলকান্দি ইউনিয়নের বাঘাইকান্দি ও তুলাকান্দি গ্রামে। এই দুটি গ্রামের ৬৩ জন কৃষক ঋণ না নিয়েও জনতা ব্যাংক ভৈরব বাজার শাখা থেকে গত ১২ আগস্ট ঋণ পরিশোধের নোটিশ পেয়েছেন। তারা নোটিশ পাওয়ার পরই জালিয়াতির ঘটনাটি ধরা পড়ে। তারপর এলাকায় এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়।
এ ঘটনায় প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) জনতা ব্যাংকের ময়মনসিংহের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে এসপিও অফিসার সুজন কুমার সাহার নেতৃত্বে একটি তদন্ত টিম ভৈরব বাজার শাখায় এসেছে। তদন্ত কর্মকর্তা এই প্রতিনিধির কাছে বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাংকের শাখা ম্যানেজার তুলিপ কুমার সাহা কর্মরত অবস্থায় ভৈরব উপজেলার বাঘাইকান্দি ও তুলাকান্দি গ্রামে ১২৬ জন কৃষককে কয়েক কোটি টাকা কৃষিঋণ দেন। এদের মধ্যে ২৬ জন কৃষক কোনোদিন ব্যাংকে এসে ঋণের আবেদনই করেননি। ৩৭ জন ব্যাংকে এসে জাতীয় আইডি কার্ড ও ছবি দিয়ে আবেদন করে প্রত্যকে ১৫০০-৩০০০ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। তখন এই ৩৭ জনকে বলা হয়েছিল, করোনার জন্য তাদের সরকারি প্রণোদনার টাকা দেওয়া হয়েছে। ঋণগ্রহীতাদের মধ্য আলকাছ নামের এক ভিক্ষুক ও সাজিদ মিয়া নামের এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির নামও রয়েছে বলে জানা গেছে।
ঋণ পরিশোধের নোটিশ পেয়ে ২০ জন কৃষক শাখা ম্যানেজারের কাছে লিখিত আবেদন করে জানান, তারা ব্যাংকের এই শাখা থেকে কোনো প্রকার ঋণ নেননি।
সুজন নামের একজন কৃষক বলেন, ‘আমি ব্যাংক থেকে কোনোদিন ঋণ নিইনি। অথচ আমার নামে ২০ হাজার টাকা, সুদসহ ৩৪ হাজার ৯৫০ টাকা পরিশোধের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এখন আমি কী করবো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।’
আরেক কৃষক আক্কাছ মিয়া বলেন, ‘আমি নাকি জনতা ব্যাংক থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। সুদসহ ৮৭ হাজার ৬২৮ টাকা পরিশোধের নোটিশ দেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। নোটিশ পেয়ে আমার মাথায় হাত! আকাশ ভেঙে পড়েছে আমার ওপর।’
সেলিম নামের আরেক কৃষক বলেন, ‘এলাকার এক দালাল আমার কাছ থেকে জাতীয় আইডি কার্ড ও ছবি নেয় ২০২২ সালে। তখন করোনার প্রণোদনার কথা বলে আমাকে তিন হাজার টাকা দেয় ওই দালাল। এখন নোটিশ পেলাম সুদসহ ৮৩ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। আমি কোথা থেকে এই টাকা পরিশোধ করবো?’।
বিষয়টি অবগত হয়ে জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে উপমহাব্যবস্থাপক (এরিয়া ইনচার্জ) সই করা ময়মনসিংহের আঞ্চলিক কার্যালয়ে একটি পত্র দিয়ে বিষয়টি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়। পত্রটিতে পুরো ঘটনা উল্লেখ করা হয়।
মঙ্গলবার ভৈরব বাজার শাখায় ঘটনার তদন্তে আসা ময়মনসিংহের আঞ্চলিক অফিসের এসপিও অফিসার সুজন কুমার সাহা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা ঘটনাটি অধিকতর তদন্ত করতে এসেছি। তদন্ত কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি কিছুই বলতে পারবো না।’
ব্যাংকের ভৈরব বাজার শাখার ম্যানেজার আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনাটি আমি উদঘাটন করেছি। আমি বর্তমানে কর্মরত অবস্থায় ঋণগ্রহীতাদের নোটিশ দিলে ঘটনা বেরিয়ে আসে। নোটিশ নিয়ে গেলে ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকের লোকজনকে আটকিয়ে রাখেন। খবর পেয়ে আমি নিজে গিয়ে তাদের উদ্ধার করি।’
এ ঘটনায় আগের ম্যানেজার তুলিপ কুমার সাহাসহ দুজন সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন বলে ম্যানেজার স্বীকার করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। কোনো কৃষক ঋণ না নেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হলে বিবেচনা করে অফিসিয়াল ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত সাবেক ম্যানেজার তুলিপ কুমার সাহাকে ফোন করে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি নিয়ে আমাকে কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত করেছে। ঘটনার আড়ালে অনেক কিছুই আছে। ঋণ গ্রহণ করে কেউ অস্বীকার করলে তা কাগজপত্রে প্রমাণ হবে। আপাতত এর বেশি কিছু আমি বলতে পারবো না।’
জনতা ব্যাংকের ময়মনসিংহ অঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) ফারজানা খালেক ঘটনাটি স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি নিয়ে অধিকতর তদন্ত করা হচ্ছে। এটি প্রধান কার্যালয় অবগত আছে।
তিনি আরও বলেন, শাখার ম্যানেজার দায়িত্বে থেকে কোনো ঋণ জালিয়াতি করে রেহাই পাবে না। এরইমধ্য অভিযুক্ত ম্যানেজারসহ দুজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ঋণ জালিয়াতির বিষয়টি প্রমাণিত হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যানেজারসহ তার সঙ্গে জড়িত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল ব্যবস্থা বা শাস্তি নেওয়া হবে।
রাজীবুল হাসান/এসআর/এএসএম