অর্থ কেলেঙ্কারীর তদন্ত চায় পদ্মা ব্যাংকের আমানতকারীরা

3 months ago 30

পদ্মা ব্যাংকে টাকা রেখে প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন আমানতকারীরা। তারা বলছেন, নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত ভেবে ব্যাংকে আমানত রেখেছিলেন। কিন্তু বিগত সরকারের ছত্রছায়ায় একটি চক্র দেশের ব্যাংকিং খাতকে লুটের রাজ্যে পরিণত করেছে। দিশাহারা আমানতকারীরা ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে সমাধান পাচ্ছেন না। অনেকে পদ্মা ব্যাংক কর্মকর্তাদের হাতে পায়ে ধরেও টাকা তুলতে পারছেন না। 

শনিবার (১৭ মে) রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটি (ডিআরইউ) সাগর-রুনী মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলন এ অভিযোগ তুলে ধরেন তারা। 

এসময় অর্থ ফেরতের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমাসহ রোডম্যাপ দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। পাশাপাশি- বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে নিরপেক্ষ তদন্ত করা; অভিযুক্তদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা, পাসপোর্ট বাতিল এবং সম্পদ জব্দের নির্দেশনার দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। 

সংবাদ সম্মেলনে মো. ইব্রাহিম বলেন, এখানে শুধু আমাদের দুঃখ-কষ্ট জানাতে আসিনি, বরং বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ একটি ব্যাংকিং দুর্নীতির বিষয় জনসম্মুখে উন্মোচন করতে এসেছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, সুপরিকল্পিত আর্থিক কেলেঙ্কারির হোতাদের প্রকাশ্যে আনা। যারা দুই লাখ আমানতকারীর সঞ্চয়, পেনশন এবং ব্যবসায়িক অর্থ লুট করে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। 

তিনি বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের পর, কীভাবে তারেক রেজা খান পদ্মা ব্যাংক থেকে পদত্যাগের পর, ব্যাংক ত্যাগের জন্য অনাপত্তিপত্র পেয়েছেন এবং এখনো ব্যাংকিং খাতে সক্রিয় রয়েছেন? আরও উদ্বেগজনক হলো- তার সাথে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ সহযোগীরাও বিভিন্ন ব্যাংকে দায়িত্বে রয়েছেন, যেন কিছুই ঘটেনি। এটি শুধু বিচারহীনতার একটি উদাহরণ নয়, বরং বাংলাদেশের আর্থিক খাতের ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার প্রতি চরম অবহেলার প্রতিচ্ছবি। আমরা জানতে চাই- কে বা কারা এইসব দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে? এ ধরনের অপরাধীদের প্রতি শিথিলতা যদি চলতে থাকে, তাহলে দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রতি আমানতকারীদের আস্থা কোনোদিন ফিরবে না। 

মার্জিয়া আক্তার বলেন, আমার বাবা পরিবারের সুখের কথা চিন্তা করে পদ্মা ব্যাংকে আমানত রেখেছেন। কিন্তু এখন মা গুরুতর অসুস্থ, কিডনি সমস্যায় ভুগছেন। চর এই বিপদের সময় বাবার হাতে টাকা নেই। মায়ের চিকিৎসা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ব্যাংকে টাকা থাকলেও মাসের পর মাস নিজেদের টাকা তুলতে পারছিনা। ব্রাঞ্চ কর্মকর্তারা আজ, কাল, পরশু বলে সময় ক্ষেপণ করছেন। পর্যায়ক্রমে পদ্মা ব্যাংকে প্রতারিত অনেক ভুক্তভোগীদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এখন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, এর সমাধান চাই। আমাদের আমানত ফেরত দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক পদ্মা ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছে, তাদের দায়ভার নিতে হবে। আমরা আর সহ্য করতে পারছি না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে বলব, আমার মাকে বাঁচান, আমাদের টাকা ফেরত দিন। 

আরেক আমানতকারী জুয়েলা আক্তার বলেন, তিল তিল করে জোগাড় করা টাকা ব্যাংকে রেখেছি। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও নিরাপদ মনে করে ব্যাংকে টাকা রেখেছেন, এখন আমরা টাকা পাচ্ছি না। বলা হয়- বিপদের বন্ধু সঞ্চয়। আর আমরা যখন বিপদে তখন সঞ্চয় তুলতে পারছিনা। এর থেকে যন্ত্রণা আর কিছু হতে পারে না। অনেক সময় ব্যাংকে টাকার জন্য গেলে কর্মকর্তারা আামদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। ধমক দিয়ে বের করে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে আমরা কার কাছে যাবে, কার কাছে সমাধান চাইব। দেশে কি আমাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নাই!

লিখিত বক্তব্যে বক্তারা বলেন, চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তার নেতৃত্বে ব্যাংকের সংকট উত্তরণের আশার আলো দেখা যেতে শুরু করে, এবং বাংলাদেশ ব্যাংক তার বিদেশি বিনিয়োগ আনার প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ব্যাংকটিকে কয়েকটি নীতিগত সুবিধা প্রদান করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সরাফাত তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হন। পরিবর্তে তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের কাছে মোট ৭১৫ কোটি টাকায় পদ্মা ব্যাংকের ৬৫% শেয়ার বিক্রি করেন। এই লেনদেনের পর মি. সরাফাতের আচরণ আরও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে এবং তার বিরুদ্ধে আরও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের সহায়তায় তিনি প্রভাবশালী অবস্থানে চলে যান এবং নানা উপায়ে ব্যাংক থেকে সম্পদ লুটপাট করতে থাকেন।

এটি বিচ্ছিন্ন কোনো দুর্নীতির ঘটনা নয় এটি দীর্ঘদিন ধরে চলা একটি গোপন অংশীদারিত্ব জানিয়ে আমানতকারী ফয়সাল ভূইয়া বলেন : এই দুর্নীতির মূল কেন্দ্রে রয়েছেন দুজন প্রভাবশালী ব্যক্তি পদ্মা ব্যাংক পিএলসি সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিস সরাফাত এবং সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও তারেক রিয়াজ খান। 

এই অভ্যন্তরীণ চক্রটি নিম্নোক্ত অপরাধে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ জালিয়াতি ও ভুয়া নথির মাধ্যমে ঋণ অনুমোদন, অনুমোদন ছাড়াই এসএমই ঋণের বিতরণ, প্রায় ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ (ভুয়া ঋণ বিতরণ এর মাধ্যমে) বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ আছে। তারেক রিয়াজ খান যখন ২০১৯ সালে এমডি হিসেবে যোগ দেন, তখন পদ্মা ব্যাংকের হাতে ছিল ১২০০ কোটি টাকা নগদ। ২০২৪ সালে তার পদত্যাগের সময় ব্যাংকের অবস্থান দাঁড়ায় ঋণাত্মক ৪০০ কোটি টাকা।

সংবাদ সম্মেলনে আমানতকারী মিরাজুর রহমান বলেন, ব্যবসার টাকা ব্যাংকে রেখ এখন আমরা পথের ভিখারি। কষ্টার্জিত আমানত ফেরত পাচ্ছি না। ব্যাংকের শাখা অফিস, প্রধান অফিস ও বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েও সমাধান পাচ্ছি না। এর পরিণতিতে আমরা, সাধারণ আমানতকারীরা, আমাদের জমানো সব সঞ্চয় হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি।

Read Entire Article