জিআই সনদে পনিরের কদর বাড়ছে

3 months ago 48

গরু ও মহিষের দুধের তৈরি অসাধারণ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ মুখরোচক খাবারের নাম পনির। ষোড়শ শতকে মোগল দরবারের খাদ্য তালিকায় অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠে এটি। যুগের পর যুগ বিশেষ এ খাবারটি ভোজনরসিকদের আকৃষ্ট করে তোলে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছাড়িয়ে পড়ে এ পনিরের সুনাম।

প্রায় ৪০০ বছর আগে কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামের পনির তৈরি শুরু হয়। দেশের সীমা ছাড়িয়ে এ পনিরের খ্যাতি ছাড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। সম্প্রতি অষ্টগ্রামের বিখ্যাত দুগ্ধজাত এ খাবারকে ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের সনদ দেওয়া হয়। এতে করে বাড়ছে পনির ব্যবসার পরিধি।

স্থানীয়রা জানান, ষোড়শ শতকে মোঘল সম্রাটের এক বিশেষ বাহিনী অষ্টগ্রামে আস্তানা গড়েন। তাদের একজন ছিলেন পনির খান। তার বাবার নাম দেলোয়ার খান। তিনি এখানকার হাওরে গরু-মহিষের বাথান দেখে হতবাক হন। এক পর্যায়ে তিনি নিজ হাতে গরু-মহিষের দুধ দিয়ে এ দুগ্ধজাত বিশেষ খাবার তৈরি করেন। এ খাবার মোগল সম্রাটের দরবারেও জনপ্রিয় হয়ে।

পনির খানের হাতে তৈরি বলেই এ দুগ্ধজাত খাবারের নামকরণ করা হয় পনির। তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে এলাকার মানুষ ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পনির তৈরির কাজ শুরু করে। কালক্রমে অষ্টগ্রাম উপজেলার কারবালাহাটি গ্রামটি হয়ে ওঠে পনির পল্লি হিসাবে। অষ্টগ্রামের সব থেকে বেশি পনির তৈরি হয় এ গ্রামে।

জিআই সনদে পনিরের কদর বাড়ছে

পনির তৈরির কারিগর নিশান মিয়া বলেন, ‘অষ্টগ্রামের পনির দেশ-বিদেশে রপ্তানি হয়। পর্যটকরাও এখানে এসে পনির কিনে নিয়ে যান। মন্ত্রী-এমপিরাও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অষ্টগ্রাম থেকে পনির নিয়ে যান। শুনেছি সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কল্যাণে সে পনির বঙ্গভবনে আপ্যায়নের উপকরণে পরিণত হয়। সরকার আমাদের পনিরকে জিআই স্বীকৃতি দিয়েছে। এখন পনিরের মান ও দাম আরও বাড়বে।’

কারবালাহাটি গ্রামের বাসিন্দা মো. উজ্জ্বল মিয়া বলেন, ‘পনির ঐতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত খাবার। আমাদের অষ্টগ্রামের পনিরকে সরকার জিআই সনদ দিয়েছে এতে আমার গর্বিত ও আনন্দিত।’

জিআই সনদে পনিরের কদর বাড়ছে

পনির তৈরির কারিগর রিকা আক্তার জাগো নিউজকে জানান, ‘ছানা তৈরি করে এক কেজি পনির তৈরি করতে ১০ কেজি গরুর দুধ বা ৯ কেজি মহিষের দুধ লাগে। এসব পনির ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা কেজি বিক্রি করা যায়। যারাই আমাদের পনির খেয়েছেন তাদের প্রত্যেকে প্রশংসায় করেছেন। শুনেছি পনিরকে সরকার জিআই সনদ দিয়েছে। এখন হয়তো পনির তৈরিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প রূপ দিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা করা হবে ‘

অষ্টগ্রাম সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ ফাইয়াজ হাসান বাবু বলেন, ‘এক সময় অষ্টগ্রামের শতাধিক পরিবার পনির তৈরি করতেন। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বর্তমানে ২০টি পরিবার এ পেশার সঙ্গে জড়িত। পনির তৈরির শিল্পে সরকারি সহায়তা, সহজ ঋণ, প্রশিক্ষণ ও বাজারজাতকরণের সুযোগ থাকলে অনেকে এ ব্যবসায় যুক্ত হতে আগ্রহী।’

হাওরের সন্তান অ্যাডভোকেট শেখ মোহাম্মদ রোকন রেজা বলেন, ‘সরকারের দেওয়া জিআই সনদের কারণে এ পণ্য তৈরি বাড়বে। বিশেষ করে হাওরে গরু পালন ও দুধ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত কৃষকদের জন্য এটি লাভজনক উদ্যোগ হতে পারে। তবে এ শিল্পকে আরও বিকশিত করতে হলে প্রয়োজন সরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ।’

জিআই সনদে পনিরের কদর বাড়ছে

তিনি আরও বলেন, ‘প্রশিক্ষণ, মান নিয়ন্ত্রণ, বাজারজাতকরণে সহায়তা, সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, এবং কর-প্রণোদনার মতো বিষয়গুলো এ শিল্পে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে সহায়ক হতে পারে। সরকার যদি প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে তবে অষ্টগ্রামের পনির শিল্পের সঙ্গে নতুন উদ্যোক্তা যুক্ত হবে।’

অষ্টগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. দিলশাদ জাহান জাগো নিউজকে জানান, ‘সরকারিভাবে আমরা অষ্টগ্রামের পনিরকে ব্র্যান্ডিং চাই। জাইকা প্রকল্পের আওতায় পনিরের জন্য একটা সেলস সেন্টার করার চিন্তা করেছি। বর্ষা মৌসুমে অষ্টগ্রামে অনেক পর্যটক আসে। পর্যটকদের মধ্যেও পনিরের প্রসার ঘটানো চিন্তা রয়েছে।’

জিআই সনদে পনিরের কদর বাড়ছে

তিনি আরও বলেন, ‘অষ্টগ্রামে সরকারি তালিকাভুক্ত ১৪ জন পনির তৈরির কারিগর রয়েছেন। যারা নিজেরাই তৈরি করে বিক্রি করেন। তাদের বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ পেশার সঙ্গে জড়িতদের সরকারিভাবে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।’

যেভাবে তৈরি হয় পনির
প্রথমে কাঁচা দুধ সংগ্রহ করে বড় একটি পাত্রে রাখা হয়। তারপর পুরোনো ছানা দিয়ে ১৫-২০ মিনিট রেখে দেওয়া হয়। ৫-৭ মিনিট পর বাঁশের কাঠি দিয়ে পরীক্ষা করা হয় দুধ জমাট বাঁধছে কিনা। জমাট বেঁধে ছানায় পরিণত হলে চাকু দিয়ে কেটে পিস করা হয়। আর পাত্রে জমানো পানি ফেলে দেওয়া হয়। এরপর ছানার পিসগুলো বাঁশের টুকরি বা ফর্মায় তোলা হয়। পনিরের পানি ঝরে যাওয়ার পর প্রতিটি পনিরের মাঝে ছিদ্র করে লবণ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। লবণ দিলে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। পরে সে পনির পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে প্যাকেট করা হয়। এককেজি পনির তৈরিতে প্রায় কেজি দুধের প্রয়োজন হয়।

বিপণন ও রপ্তানি সম্ভাবনা
জিআই সনদ পাওয়ায় অষ্টগ্রামের পনির এখন একটি মর্যাদাপূর্ণ ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের বাজারের পাশাপাশি বিদেশেও এ পণ্যের চাহিদা বাড়বে। যে সব ব্যবসায়ী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাইকারি পনির বিক্রি শুরু করেছেন তারা জিআই লোগো দিয়ে পণ্যের ব্র্যান্ডিং বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন। জেলা প্রশাসনও বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছেন।

এসকে রাসেল/আরএইচ/জেআইএম

Read Entire Article