গ্রামীণ মেলায় মণ্ডা-মিঠাইয়ের পাশাপাশি সাদা ঝুরিপিঠাও দেখা যায় অহরহ। মেলায় আসা মানুষগুলো বুন্দিয়া, জিলাপি ও বিভিন্ন রকমের মিষ্টির পাশাপাশি কিনে নিয়ে যান সুস্বাদু ঝুরি পিঠা। মেলা ছাড়াও বর্তমানে সারা বছরই হাঁটে-বাজারে ঝুরিপিঠার চাহিদা রয়েছে।
গ্রামবাংলার নারী ও শিশুদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই ঝুরিপিঠা তৈরি করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের হাঁট পাঁচিল গ্রামের যমুনার ভাঙন কবলিত কয়েকশত পরিবার।
এক সময় ঘর ছিল, বাড়ি ছিল, ছিল জমিজমাও। এখন তাদের এতটুকো আশ্রয়ও নেই। বাঁধের কিনারেই ঝুপড়ি ঘর তুলে সেখানেই বসবাস করেন যমুনার ভাঙনে সর্বস্ব হারোনা অসহায় মানুষগুলো। কেউ বা অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে সেখানেই ছোট্ট একটি ঘর তুলে বসবাস করছেন। আয়ের অন্য কোনো পথ না থাকায় তারা চালের কুঁড়োয় ঝুরিপিঠা বানিয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন ভোররাতে বাঁধের প্রতিটি ঝুপরে কুঁড়েঘর নারীদের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। বড় বড় পাতিলে পানি গরম করার পর তাঁতে আতপ চালের কুঁড়ো ও লবণ দিয়ে সিদ্ধ করেন তারা। এরপর সেগুলো থেকেই তৈরি হয় খামির। খামিরটাকে ছোট ছোট গোলাকৃতি করে রাখা হয়। ভোরে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গোলাকৃতির খামিরগুলো মাটি কিংবা স্টিলের তৈরি সাঁচ অথবা ঝাঁঝরের ভেতরে দিয়ে ঘষা দিলেই ছিদ্র দিয়ে লম্বা লতার মতো ঝুরিপিঠা বের হয়। পিঠাগুলো তিন চার পাঁচদিন রোদে শুকানোর পর মাটির পাত্রে বালু গরম করে ভেজে নিতে হয়। এভাবেই তৈরি হয় সুস্বাদু ঝুরিপিঠা।
কথা হয় ঝুরি তৈরির সঙ্গে জড়িত একাধিক নারী-পুরুষের সঙ্গে। তারা বলেন, বর্তমানে ঝুরিপিঠার চাহিদা রয়েছে। এই পিঠা তৈরিতে নারী-পুরুষ সবাই মিলে কাজ করেন তারা। রাতদিন পরিশ্রম করে পিঠা বানানো হয়। তাদের তৈরি ঝুরিপিঠা দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়। শীতকালে গ্রামীণ মেলা, ধর্মীয় সভা থাকায় ঝুরিপিঠার চাহিদা আরও বেড়ে যায়।
জোবেদা খাতুন, টিয়া খাতুন, আমেনা বেগমসহ ঝুরি তৈরির সঙ্গে বেশ কয়েক নারী বলেন, আমরা এখানে সবাই নদীভাঙন কবলিত। বাড়িঘর সব হারিয়ে কেউ ওয়াপদার ঢালে আবার কেউ অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করি। আমাদের আয়ের অন্য কোনো উৎস না থাকায় ঝুরিপিঠা বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি।
আব্দুল মোত্তালেব বলেন, নদীতে বাড়িঘর ভাইঙ্গা গেছে, বাঁধের ওপর বাড়ি করেছি। এখন বাঁধের ওপর থেকেও উচ্ছেদ করে দিয়েছে। আমরা অন্যের জমি ভাড়া করে ঝুরি বানিয়েই জীবিকা নির্বাহ করছি।
আব্দুর রশিদ বলেন, এক বস্তা আটার ঝুরি তৈরি করতে ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় ৪২শ থেকে ৪৩শ টাকায়। যদি আকাশের অবস্থা খারাপ হয় তাহলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে।
বানু বেগম বলেন, চালকল থেকে আটা ভাঙিয়ে পানি গরম করে তাতে আটা দিয়ে ঘোটা হয়। তারপর ঝাঁঝর দিয়ে ঝুরি তৈরি করা হয়। এরপর পাঁচদিন ধরে শুকানো হয়। শুকানোর পর গরম বালুতে ঝুরি ভেজে ঝুরি প্রস্তুত হয়। এরপর পাইকাররা এসে ঝুরি কিনে নিয়ে যান।
প্রধান শিক্ষক লোকমান হোসেন সরকার বলেন, হাঁট পাঁচিল গ্রামের এটাকে কুটিরশিল্প বলবো। চাউলের কুঁড়ো থেকে সুস্বাদু খাবার তৈরি হচ্ছে। সারা বাংলাদেশের মধ্যে সুস্বাদু খাবার। খোলামেলায় জায়গায় তৈরি হয়। নদীভাঙন কবলিত খেটে খাওয়া মানুষগুলো ভোররাত থেকে শুরু করে দিনভর পরিশ্রম করে।
তিনি বলেন, সব খাদ্যেই কোনো কোনো না ভেজাল থাকে। কিন্তু এই খাদ্যে কোনো প্রকার কেমিক্যাল বা ভেজাল নেই। সরকারিভাবে আর্থিক প্রণোদনা বা সহযোগিতা থাকলে এই কুটিরশিল্পটি বিকশিত হবে।
পাইকারি ঝুরি ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন বলেন, সাত বছর ধরে আমি এখান থেকে ঝুরি পাইকারি কিনে বিভিন্ন গ্রামের জলসায়-মেলাতে বিক্রি করছি। নানা পালা-পার্বণে, উৎসবে, গ্রামীণ মেলায় ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবার হিসেবে ঝুরি পিঠার দেশব্যাপী ব্যাপক চাহিদা আছে। ঝুরি তৈরি করে বিক্রিতে কোনো কষ্ট করতে হচ্ছে না। লাভও একেবারে কম হচ্ছে না।
চালকল মালিক আইয়ুব আলী বলেন, ঝুরি তৈরিকে কেন্দ্র করে গ্রামটিতে এখনো চারটি চালকল আছে। ঝুরি তৈরির জন্য এসব চালকল থেকেই আতপ চালের গুঁড়া নিয়ে থাকেন প্রস্তুতকারকেরা। অনেকেই বাকিতেও দেওয়া হয়।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, হাঁট পাঁচিলে ভাঙন কবলিত মানুষগুলো ঝুরিপিঠা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে আমি শুনেছি। তবে তারা কেউ আমাদের কাছে আসেনি। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণের আওতায় এসব গ্রামীণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে বলে আমরা জানি।