ডাকসু ঘিরে উচ্চাশার পারদ

7 hours ago 3

মাত্রা ও সূচকে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের গোটা আবহটাই ভিন্ন। তারওপর ডাকসু নির্বাচন কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিষয় নয়। নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বলা হলেও এ কেন্দ্রটির দিকে অনেকের ভর-ভরসা। সঙ্গে আগামীর অনেক বার্তাও। ডাকসু ছাড়াও জাকসু, রাকসু, চাকসুসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত না হওয়ায় জাতীয় রাজনীতির  নেতৃত্বে মেধাশূন্যতার কথা বহুল আলোচিত। এ নির্বাচনগুলো নিয়মিত হলে জয়ী-পরাজিত প্রার্থীদের পরবর্তী পারফরমেন্স হতে পারতো জাতীয় রাজনীতিতে। আমাদের জাতীয় নির্বাচন আয়োজক নির্বাচন কমিশনও নিতে পারতো কিছু অভিজ্ঞতা। জাতীয় রাজনীতির মতো আমাদের জাতীয় নির্বাচন আয়োজক কর্তৃপক্ষের মানও যে ক্রমেই অবনতি ঘটেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বিচারক নন, প্রশাসকও নন। তারা মূলত গবেষক। তারা কেবল ছাত্রদের গড়ে তোলেন না, শিক্ষকও তৈরি করেন। বিচারক, প্রশাসকদের পাঠ-পঠন দেন। আর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সময় নিজেদেরই বিচারক হতে হয়, প্রশাসকও হতে হয়। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কমিশনারসহ যাবতীয় পরিচালনা তারাই করেন। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কয়েকজন শিক্ষকের নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত কর্মযজ্ঞ ও পরিশ্রম এখনো অনেকের জানার বাইরে।  

সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত হলের বাইরে আটটি কেন্দ্রে প্রায় ৪০ হাজার ভোট নেয়ার কতো কঠিন কাজ সাঙ্গ করতে হচ্ছে তাদের। অন্যবারের তুলনায় এবার ডাকসুতে ব্যালটের আকার বেড়েছে। এবার ভোটারদের ৪১টি ভোট। ভোট নিতে হচ্ছে অপটিক্যাল মার্ক রিকগনিশন-ওএমআর শিটে। এবার ডাকসুতে ২৮টি পদের বিপরীতে প্রার্থী ৪৭১ জন। হল সংসদের ২৩৪টি পদের বিপরীতে প্রার্থী ১ হাজার ৩৫ জন। ভোটের আগে ভোট দেওয়ার নিয়মকানুন ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে জানিয়েছে। ভিডিও চিত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রকাশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ভোট প্রদানে ছাত্র–ছাত্রীকে উৎসাহিত করতে তিনটি অনুষদ ও একটি ইনস্টিটিউটে সভা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এসব সভায়ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নতুন ভোটারদের ভোটদানের পদ্ধতি সম্পর্কে জানিয়েছে। এবারের ডাকসু নির্বাচনে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জড়িত বৈধ রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগী ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রায় সব কটিই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শরিক। আছেন বিপুলসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীও। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি নারী প্রার্থী।

বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা সব সময়েই ছিল নির্ধারক। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম-প্রতিটি পর্বেই ছাত্রসমাজ ছিল সামনের কাতারে। তিন দশকের বেশি সময় পর এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা করায় উচ্চাশার পারদ একটু বেশি তুঙ্গে। দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচন না হওয়ায় ক্যাম্পাসগুলোতে যে নেতৃত্বশূন্যতা ও গণতান্ত্রিক অনুশীলনের অভাব তৈরি হয়েছিল, তা দেশের রাজনীতির জন্যও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া, চব্বিশের আন্দোলনে যোগ হয়েছে শিক্ষার্থীরা যোগ করেছে ঐতিহাসিক মাত্রা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতিতে ভোটের রেকর্ড হয়েছে এবার। সেখানে ব্যালট পেপার ৩০ পাতার। ডাকসু নির্বাচন কমিশনের এ কর্মযজ্ঞ জাকসু, চাকসু, রাকসুসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুপ্রাণিত না করে পারে না। অবশেষে আমাদের জাতীয় নির্বাচন কমিশনের জন্যও নিশ্চয়ই কিছু খোরাক দেবে। বাংলাদেশের আগের যে কোনো নির্বাচন কমিশনের চেয়ে এবারের কমিশনের চেয়ে কাজের ভলিউম বড়। আর চব্বিশ পরবর্তী যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন আগের চেয়ে ভিন্ন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করে। দীর্ঘ ১২ বছর প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় সম্পন্ন করে একজন শিক্ষার্থী হাজারো রাত জাগা পরিশ্রম আর প্রবল আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন হৃদয়ে ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় পা রাখে, নিজের ভবিষ্যৎ এবং পরিবারের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেবল শিক্ষার জায়গা নয়, বরং পুরো অঞ্চলের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের কেন্দ্র। ওই এলাকা বা অঞ্চলে এ ছাত্র নেতারা এক ধরনের জনপ্রতিনিধি। ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেবল একটি ক্যাম্পাসভিত্তিক আয়োজন নয়; বরং এটি জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার সঙ্গেও যুক্ত।

বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা সব সময়েই ছিল নির্ধারক। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম-প্রতিটি পর্বেই ছাত্রসমাজ ছিল সামনের কাতারে। তিন দশকের বেশি সময় পর এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা করায় উচ্চাশার পারদ একটু বেশি তুঙ্গে। দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচন না হওয়ায় ক্যাম্পাসগুলোতে যে নেতৃত্বশূন্যতা ও গণতান্ত্রিক অনুশীলনের অভাব তৈরি হয়েছিল, তা দেশের রাজনীতির জন্যও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া, চব্বিশের আন্দোলনে যোগ হয়েছে শিক্ষার্থীরা যোগ করেছে ঐতিহাসিক মাত্রা।

তারুণ্যকে অগ্রাহ্য তাচ্ছিল্য করার একটি প্রবণতা মনোজাগতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। নানা কারণ দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন আটকে রাখা  নিয়েও অনেক কথা আছে। প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর এ বিষয়ক মানসিকতা প্রায় অভিন্ন। এ সময়ে বিনাভোট, রাতের ভোট, ডামি-আমিসহ যে মার্কার নির্বাচনই হোক আমাদের জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে। পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নির্বাচন বন্ধ থাকেনি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এমন কি কর্মচারী সমিতির নির্বাচনও হয়েছে। হয়নি কেবল ছাত্র সংসদ নির্বাচন। নানান ঘটনার পরম্পরায় দীর্ঘ সময়ে এই নির্বাচন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদবিহীন এক শূন্যতা তৈরি হয়। গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় পরিবর্তন এসেছে। এখন ভিন্ন এক আঙ্গিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ডাকসু দিয়েই হতে যাচ্ছে সেই অভিযাত্রার অভিষেক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর বিগত ১০৪ বছরে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়েছে ৩৭ বার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫৪ বছরে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে সাতবার। ১৯৯১ সালে দেশে নতুন করে গণতন্ত্রে ফেরার পর ডাকসু নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত এক দফা নির্বাচনের পর গঠিত ডাকসু ও হল সংসদ কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারেনি। পেছনে তাকিয়ে দেখা যায়, ৩৬ বছর আগে রাকসু, ৩৫ বছর আগে চাকসু এবং ৩৩ বছর আগে জাকসু নির্বাচন হয়েছিল। এ নির্বাচনকে কেবল আনুষ্ঠানিকতা মনে করা ঠিক হবে না। এটি গণতন্ত্রের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকারেরও পরীক্ষা। সহিংসতা, দখলদারি ও দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ধারা ধরে রাখতে হবে।

কেবল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজেও এক্সট্রা কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি তৈরি করে। ডিবেটিং ক্লাব, সাংস্কৃতিক ক্লাব, ক্রীড়া ক্লাব, রক্তদান ক্লাবসহ নানা স্বীকৃত সংগঠন থাকে, যেখানে শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায় সম্পৃক্ত থেকে জ্ঞান অর্জন করে এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করে। বিশ্বজুড়ে এটাই এখনো পর্যন্ত আধুনিক ধারণা। কারণ এ ধরনের এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি শিক্ষার্থীদের কেবল একাডেমিকভাবেই নয়, সামাজিক ও পেশাগতভাবে দক্ষ, দায়িত্বশীল ও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। আমাদের দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র না থাকার কারণে, ছাত্র সংসদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য সংগঠনের মতো হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় সীমা অতিক্রম করে এটি জাতীয় রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করছে। সামনে ছাত্র সংসদের ক্ষমতা কতটুকু- এ প্রশ্ন জোরদার হতে পারে।

তরুণদের আন্দোলনের একটি বৃহৎ অংশ, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের অবশ্য আপাতত এই সুযোগ মিলছে না এবং কবে সেটি হবে- এ প্রশ্নও হয়তো বাদ পড়বে না।  বাংলাদেশ কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই এদেশের সব আন্দোলন সংগ্রামে দেশের শিক্ষিত সমাজ নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল, যার মূল ভূমিকায় ছিল বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান ছিল ব্যতিক্রম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে রাষ্ট্র ক্ষমতার বাহিরে থাকা সব ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে সরকারের পতন ঘটে। তাদের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, এমন কি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরাও ছিল। প্রেক্ষিত ও ঘটনার ভিন্নতায় নতুন ন্যারেটিভ আসে। উচ্চাশাও আসে।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

এইচআর/জিকেএস

Read Entire Article