দূরশিক্ষা ও বিজ্ঞানের মহীরুহ ড. শমশের আলীর মহাপ্রস্থান : এক জ্ঞানতাপস

2 weeks ago 6

বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও শিক্ষাজগতে আরও একটি নক্ষত্রের পতন ঘটল। রোববার (২ আগস্ট ২০২৫) রাতের শেষ প্রহরে না ফেরার দেশে চলে গেছেন দেশের প্রথিতযশা পরমাণু বিজ্ঞানী, বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও বহুমুখী জ্ঞানসাধক অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ শমশের আলী। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বিজ্ঞানের প্রসার ও শিক্ষাক্ষেত্রে তার অবদান তার নামকে স্থাপন করেছে গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসনে। আজ তার কর্মময় জীবন ও কীর্তিকে স্মরণ করে আমরা জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা শহরে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মাদ শমশের আলী। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল যশোর জেলার বসুন্দিয়া গ্রামে এবং বাবা আমীর আলী ছিলেন রেলওয়ের কর্মকর্তা। শৈশবকাল কেটেছে চুয়াডাঙ্গা, ভারতের রানাঘাট এবং নিজ জেলা যশোরে। শমশের আলীর শিক্ষাজীবনের শুরু চুয়াডাঙ্গার এক স্থানীয় বিদ্যালয়ে; পরে দেশভাগের পর যশোর জিলা স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। ছাত্র হিসেবে অসাধারণ মেধাবী শমশের আলী স্কুল ও কলেজ জীবনে সব পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করেছেন এবং সর্বদা শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছেন। রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট (বিজ্ঞান) উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।

তিনি ১৯৫৯ সালে স্নাতক সম্মান ও ১৯৬০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন পদার্থবিজ্ঞানে। অধ্যয়নের প্রতি তার গভীর মনোনিবেশ ও প্রজ্ঞার স্বীকৃতিস্বরূপ একই সময়ে তিনি কমনওয়েলথ স্কলারশিপসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক বৃত্তি অর্জন করেন। পরমাণু পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চতর গবেষণার আকাঙ্ক্ষা থেকে ১৯৬১ সালে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর আব্দুস সালামের পরামর্শে তিনি যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। সেখানে কিংবদন্তি পদার্থবিজ্ঞানী লর্ড ব্রায়ান ফ্লাওয়ার্স ও স্যার স্যাম এডওয়ার্ডস-এর তত্ত্বাবধানে গবেষণা সম্পন্ন করে ১৯৬৫ সালে তাত্ত্বিক পারমাণবিক পদার্থবিদ্যায় পিএইচ.ডি. উপাধি অর্জন করেন শমশের আলী। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে তার মেধা ও অধ্যবসায়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

ড. শমশের আলী গবেষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন তার গভীর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও সৃষ্টিশীল চিন্তাশক্তির মাধ্যমে। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষত পারমাণবিক ভৌতবিজ্ঞানে তার মৌলিক গবেষণা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সমাদৃত হয়েছিল; বিশ্বের স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক জার্নালসমূহে তার অসংখ্য গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬৫ সালে পিএইচ.ডি শেষে দেশে ফিরে তিনি পাকিস্তান (পরবর্তীতে বাংলাদেশ) পরমাণু শক্তি কমিশনে গবেষণা কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন। আসলে এরও আগে ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির ফল প্রকাশের আগেই পাকিস্তান পরমাণু শক্তি কমিশনে একটি বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার পদে যোগ দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা পরমাণু শক্তি কেন্দ্রে সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। দুর্দান্ত কর্মদক্ষতা ও নেতৃত্বের যোগ্যতার কারণে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে ১৯৭০ সালে তাকে সেই পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়, যা তিনি ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সফলতার সাথে পালন করেন। 

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের গবেষণা কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে তিনি প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৭৫-৮২ সময়কালে দায়িত্ব পালন করেন। এভাবে টানা ২১ বছর ধরে (১৯৬১-১৯৮২) তিনি পরমাণু শক্তি কমিশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দেশকে পারমাণবিক গবেষণার ভিত সুদৃঢ় করতে অমূল্য ভূমিকা রেখেছেন। পারমাণবিক পদার্থবিদ্যায় তার মৌলিক গবেষণা ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালে তাঁকে সম্মানসূচক ‘অনারারি প্রফেসর’ পদবী প্রদান করে, যা ছিল এক বিরল সম্মাননা। পরের বছর, ১৯৭৪ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানে তার মৌলিক অবদানের জন্য ড. শমশের আলীকে হরি প্রসন্ন রায় স্বর্ণপদক প্রদান করে। এসব অর্জন তার গবেষণাকর্মের অসাধারণ মান ও প্রভাবের স্বীকৃতি বহন করে।

১৯৮২ সালে ড. শমশের আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। একাধারে গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে তার কৃতিত্বপূর্ণ কর্মজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রসারিত হয়; ২০০৬ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থীকে তিনি বিজ্ঞানচর্চায় অনুপ্রাণিত ও উৎসাহী করে তুলেছেন। শিক্ষক হিসেবে তার সুনাম ছিল জটিল বৈজ্ঞানিক ধারণাসমূহ সহজভাবে উপস্থাপনার দক্ষতার জন্য। একই সঙ্গে তিনি বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ে পাঠ্যক্রম উন্নয়ন ও বিজ্ঞানশিক্ষা নীতিমালা প্রণয়নে পরামর্শ দিয়ে গেছেন। বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষায় উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি দিকনির্দেশনামূলক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন এবং গণিত শিক্ষার সংকট নিয়ে একটি মূল্যবান প্রবন্ধও রচনা করেছেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত অবস্থায়ই ১৯৯২ সালে সরকারি উদ্যোগে যখন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, তিনিই এর প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ লাভ করেন। উল্লেখ্য, ‘উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়’ গঠনের ধারণাটি দেশে তিনিই সর্বপ্রথম ১৯৭৬ সালে প্রচারমাধ্যমে তুলে ধরেন এবং এ নিয়ে শুরুর দিকে অনেক সংশয় ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু অধ্যবসায়ী শমশের আলী সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে দূরশিক্ষণ পদ্ধতির এই বিশ্ববিদ্যালয় সফলভাবে গড়ে তোলেন। ১৯৯৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে  দূরশিক্ষার নীতিমালা ও কাঠামো দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে তার ভূমিকা ছিল অনন্য। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. এম শমশের আলী ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখ ‘প্রফেসর ইমেরিটাস’ পদে যোগদান করেন। 

পরে ২০০২ সালে বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি নতুনভাবে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে মাত্র ১০৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করা এ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ড. শমশের আলী তার অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনা প্রয়োগের মাধ্যমে মাত্র ছয় বছরের মধ্যে ১২,০০০-এরও বেশি শিক্ষার্থীর এক বিপুল বিদ্যাপীঠে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হন। ২০১০ সাল পর্যন্ত সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে মানসম্মত উচ্চশিক্ষার ধারায় এগিয়ে দেন। শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি তিনি গবেষণা ও প্রশাসনিক দক্ষতার মেলবন্ধনে যে উদাহরণ স্থাপন করেছেন, তা দেশের অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

দেশের বিজ্ঞান উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির সঙ্গেও ড. শমশের আলীর নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। ২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই দায়িত্বকালে একাডেমির কার্যক্রমকে তিনি আরও গতিশীল ও সমৃদ্ধ করতে উদ্যোগী ছিলেন। বিজ্ঞানীদের জাতীয় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিজ্ঞান একাডেমিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরিচিত করা ও দেশীয় গবেষণার অগ্রযাত্রায় একাডেমির ভূমিকা বাড়ানোয় তার নেতৃত্ব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে এশিয়া ও পৃথিবীর বিভিন্ন বিজ্ঞান একাডেমি ও সংস্থার সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন এবং বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা বিনিময়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

অধ্যাপক শমশের আলী শুধুই গবেষক ও প্রশাসক ছিলেন না; তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞান কমিউনিকেটর এবং চিন্তাবিদ, যার আগ্রহের বৃহৎ ক্ষেত্রজুড়ে ছিল সাধারণ মানুষের মাঝে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলা এবং বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করা। ষাটের দশক থেকে শুরু করে তিনি গণমাধ্যমে বিজ্ঞানবিষয়ক আলোচনা ও অনুষ্ঠান উপস্থাপনার পথে যুক্ত হন। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও রেডিও বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক নানা সিরিজ অনুষ্ঠানে তিনি সহজ ভাষায় বৈজ্ঞানিক ধারণা ব্যাখ্যা করে জনসাধারণকে বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট করেন। জীবদ্দশায় প্রায় ৫০০-এরও বেশি টেলিভিশন ও রেডিও অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তা ও উপস্থাপক হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন তিনি। এমনকি লন্ডন থেকে প্রচারিত বিবিসি রেডিওতেও বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত কর্মসূচিতে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন, যা বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি বিরল কৃতিত্ব। 

বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেছেন, তাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। গণিতকে ভীতি নয়, বরং আনন্দের বিষয় করে তোলার জন্য তিনি ‘Making Math Fun’ (গণিতকে মজাদার করার কৌশল) শীর্ষক ইংরেজি গ্রন্থসহ একাধিক বই রচনা করেছেন। তার লেখনীতে জটিল গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়গুলোও সহজবোধ্য ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের কাছে জ্ঞানার্জনকে আনন্দময় করে তুলেছে।

বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনে শমশের আলীর চিন্তা ও কর্ম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বিজ্ঞান ও মানবসভ্যতার আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ পরস্পরের পরিপূরক এবং সত্যিকার ধর্মচর্চা কেবল উপাসনায় নয়, জ্ঞান অনুসন্ধান ও মানবকল্যাণে উৎসর্গ হওয়া উচিত। সপ্তরের দশক থেকেই তিনি কোরআনসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কিত উপাদান নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তার নেতৃত্বে কয়েকজন বিজ্ঞানী মিলে দীর্ঘ পাঁচ বছর গবেষণা করে ‘পবিত্র কোরআনে বৈজ্ঞানিক ইঙ্গিত’ নামে একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রস্তুত করেন, যা ১৯৯০ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের উদ্যোগে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে কোরআনের আয়াতসমূহে বিজ্ঞানের যে সদিচ্ছা ও মূলনীতি নিহিত রয়েছে, তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হয়েছে। তাছাড়া মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যে অসামান্য অবদান রাখা হয়েছিল, সেই ঐতিহাসিক সত্য নতুন প্রজন্মের নিকট তুলে ধরার জন্য তিনি সহকর্মীদের নিয়ে ‘Muslim Contribution to Science and Technology’ শীর্ষক আরেকটি উল্লেখযোগ্য গবেষণা গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, যা ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়। 

ইসলামী সভ্যতার প্রায় আটশো বছরের জ্ঞানচর্চার আলোকবর্তিকা যে ইউরোপের নবজাগরণে ভূমিকা রেখেছে – এ কথাটি মনে করিয়ে দিয়ে এ গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন যে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা থেকেই বিজ্ঞানচর্চার বিকাশ ঘটানো সম্ভব। এ ছাড়াও তিনি আধুনিক কালের আরও বহু প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় গ্রন্থ ও প্রবন্ধ লিখে গেছেন, যার মধ্যে ‘ব্রেইন টুইস্টার : ডিলাইটফুল ম্যাথমেটিক্স’ এবং ‘আলাদিন্স রিয়াল ল্যাম্প (সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি)’ প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করা এবং বিজ্ঞান-সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটানোর জন্য তিনি ইতালি-ভিত্তিক তৃতীয় বিশ্ব বিজ্ঞান সংস্থা TWNSO-এর Public Understanding of Science পুরস্কার লাভ করেন ১৯৯০ সালে। তার বহুমুখী জ্ঞানসাধনার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো এবং ইসলামিক ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্সেসসহ (আম্মান) অসংখ্য বিজ্ঞান সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

অধ্যাপক শমশের আলীর দীর্ঘ কর্মজীবনে অর্জিত পুরস্কার ও সম্মাননার তালিকাও সমৃদ্ধ। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে অসাধারণ গবেষণা অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হরি প্রসন্ন রায় স্বর্ণপদক লাভের কথা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি তাঁকে ১৯৮৫ সালে একাডেমি স্বর্ণপদক প্রদান করে। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক দেওয়া হয়েছিল তাঁকে সম্মানসূচক অনারারি অধ্যাপকের খেতাব। এছাড়া বিজ্ঞান ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বহুমুখী ভূমিকার জন্য তাঁকে খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ স্বর্ণপদক (প্রাপ্তি : ২০০৫) এবং মাদার তেরেসা স্বর্ণপদকসহ বহু জাতীয় সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। 

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন; ২০০৯ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি লিডারশিপ কলোকিয়াম-এ তাঁকে উচ্চশিক্ষা নেতৃত্বে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তৃতীয় বিশ্বের বিজ্ঞান উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স (TWAS)-এর ফেলো নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স, বাংলাদেশ ফিজিক্যাল সোসাইটি ও বাংলা একাডেমির ফেলোসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ও বিদ্বৎসংস্থায় আজীবন সদস্য পদ লাভ করেছিলেন। এতসব পুরস্কার ও সম্মাননা তার বহুমুখী ক্যারিয়ার ও কৃতিত্বকে আরও উজ্জ্বলতর করে রেখেছে।

অধ্যাপক শমশের আলীর জীবন ছিল দেশের বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার অগ্রগতির এক জীবন্ত প্রতীক। একজন শিক্ষক, প্রশাসক ও বিজ্ঞানসংগ্রামী হিসেবে তিনি যেভাবে নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন, তাতে বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষার ভিত মজবুত হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান করেছেন এবং বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষায় কিভাবে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোকপাত করেছেন। বিজ্ঞানকে জনমুখী করতে স্কুল পর্যায়ে বিজ্ঞান ক্লাব আন্দোলন, বিজ্ঞান মেলা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তিনি পরোক্ষভাবে উৎসাহ জুগিয়েছেন। তার ছাত্ররা দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন, যা তার শিক্ষাগুরুরূপী অবদানেরই ফলশ্রুতি।

অধ্যাপক আলীর পরিকল্পনা ও উদ্যোগে দেশে প্রথম ওপেন ও দূরশিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন ঘটে, যা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের দ্বার সাধারণ মানুষের জন্য প্রসারিত করেছে। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশের সব স্তরের মানুষের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া। যারা প্রথাগত বা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারেন না, তাদের জন্য একটি বিকল্প সুযোগ তৈরি করে দেয়া। সমাজের সকল স্তরের, বিশেষ করে যারা কর্মজীবী, নারী বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকেন, তাদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা। আধুনিক প্রযুক্তির (যেমন: বেতার, টেলিভিশন, ই-বুক, অনলাইন ক্লাস) মাধ্যমে শিক্ষা উপকরণ এবং পাঠদানকে সহজলভ্য করা, যাতে শিক্ষার্থীরা যেকোনো স্থান থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। শুধুমাত্র তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, বরং জীবনের সাথে সম্পর্কিত এবং কর্মমুখী শিক্ষা প্রদান করা, যা দেশের দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সহায়তা করবে। সর্বোপরি, জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ অর্থাৎ যেকোনো বয়সের মানুষকে, তাদের পেশা বা অবস্থান নির্বিশেষে, পড়াশোনার সুযোগ দেয়া। এর ফলে একজন ব্যক্তি তার জীবদ্দশাজুড়ে নিজেকে নতুন করে শেখার ও বিকাশের সুযোগ পায়।

অধ্যাপক ড. শমশের আলীর প্রয়াণে বাংলাদেশ এক বিশাল মাপের মনীষীকে হারাল। বিজ্ঞান গবেষণা, শিক্ষা প্রশাসন, বিজ্ঞান-সংস্কৃতি সংযোগ ও ধর্মীয় ভাবনার পরিশীলনে তার মত বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তিত্ব বিরল। জ্ঞান-বিজ্ঞানকে মানুষের কল্যাণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের যে আদর্শ তিনি রেখে গেছেন, তা আগামী প্রজন্মের জন্য যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তিনি দেখিয়ে গেছেন, গভীর জ্ঞানচর্চা, নৈতিক মূল্যবোধ আর মানবসেবার মিশেল ঘটিয়ে সমাজে আলো ছড়ানো যায়। জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে এই গুণী পুরুষকে, আর তাৃর গড়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানসমূহ ও সৃষ্ট কর্ম আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে অনন্তকাল ধরে তার স্মৃতিকে জীবিত রাখবে। প্রিয় স্যার, আপনার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

Read Entire Article