দেড় যুগেও নির্মাণ হয়নি ভেঙে ফেলা জহির রায়হান মিলনায়তন 

2 weeks ago 6

ফেনীর সোনালি সন্তান জহির রায়হানের নামে নির্মিত জহির রায়হান মিলনায়তনটি সংস্কারের নামে ভেঙে ফেলার ১৭ বছর অতিবাহিত হলেও আজও পুনর্নির্মাণ হয়নি। ফেনী শহরের মিজান রোডে অবস্থিত শহীদ জহির রায়হান মিলনায়তনটি ছিল ফেনীর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু। একটি আধুনিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনার কথা বলে ফেনী জেলা পরিষদ ২০০৮ সালে এটি ভেঙে ফেলে। 

শহীদ জহির রায়হান মিলনায়তনকে ঘিরে ফেনীর ডজনখানেক সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয় ছিল। নিয়মিত নাট্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা হতো, হতো মহড়া। ভবন ভেঙে ফেলায় বেশিরভাগ সাংস্কৃতিক সংগঠনের অফিসগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এখন অফিস বা মহড়া কক্ষের অভাবে ফেনীর সাংস্কৃতিক চর্চা যেন অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী-সংগঠক ও সচেতন মহল বারবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দপ্তরে আবেদন জানালেও তাদের দাবিটি উপেক্ষিত রয়ে গেছে।

ষাটের দশকের শেষ দিকে ফেনী মহকুমা শহরের কেন্দ্রস্থল মিজান রোডের জেলা পরিষদ ভবনের সামনে ৪৩ শতাংশ জমিতে নির্মিত হয় ‘ফেনী টাউন হল’। ৪০০ আসনের মিলনায়তনটিতে সাংস্কৃতিক চর্চা ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠান হতো।

মিলনায়তনের একপাশে ও ছাদে ১০টি পৃথক কক্ষ ছিল। এসব কক্ষে এক সময় জেলা শিল্পকলা একাডেমি, জেলা গণগ্রন্থাগার, রেড ক্রিসেন্টের কার্যক্রম চলত। পরে ফেনী পৌর কর্তৃপক্ষ কক্ষগুলো বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বরাদ্দ দেয়। শহীদ জহির রায়হান মিলনায়তন ভবনের জমিটি মূলত জেলা পরিষদের মালিকানাধীন ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জেলা প্রশাসন মিলনায়তনটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ফেনী পৌরসভাকে দায়িত্ব দেয়। কিন্তু জমির মালিকানা হস্তান্তর করা হয়নি। ফলে সমস্যা থেকে যায়।

জেলা পরিষদের জায়গায় ‘টাউন হল’ হলেও দীর্ঘ তিন যুগ এটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে ফেনী পৌরসভা। আশির দশকের শুরুতে ফেনী টাউনহলের নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ জহির রায়হান মিলনায়তন’ করা হয়। তখন থেকে মিলনায়তনের কক্ষগুলো নামমাত্র ভাড়ায় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

২০০৮ সাল পর্যন্ত সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নিয়মিত সাংস্কৃতিক চর্চা করত এখানে। ২০০৮ সালের শেষের দিকে জেলা পরিষদ শহীদ জহির রায়হান মিলনায়তনটি ভেঙে সেখানে আরও বেশি আসনের একটি আধুনিক ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি পুনর্নির্মাণ জন্য এডিবি থেকে দেড় কোটি টাকার প্রাথমিক বরাদ্দও দেওয়া হয়। কিন্তু নতুন ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন নিয়ে জটিলতায় জেলা পরিষদ কাজ শুরু করতে পারেনি।

সাংস্কৃতিক সেবীরা জানান, মিলনায়তনটি ভেঙে ফেলায় বর্তমানে নাট্যচর্চার জন্য কাজ করা কষ্টকর। চর্চার অভাবে দিন দিন কর্মী কমতে শুরু করেছে। বর্তমান প্রজন্মের জনপ্রিয় ও আলোচিত নাট্যাচার্য প্রয়াত সেলিম আল দীন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিমের নাট্যচর্চাও এ মিলনায়তন থেকে শুরু হয়েছিল।

স্বাধীনতাপরবর্তী সাংস্কৃতিক চর্চায় ফেনী ছিল এক ঐতিহ্যের জনপদ। এ মাটিতে জন্ম নেওয়া প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা শহীদ জহির রায়হান, শহীদুল্লা কায়সার, নাট্যাচার্য ড. সেলিম আল দীন, চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম, নাট্যব্যক্তিত্ব প্রয়াত ড. ইনামুল হকসহ বহু গুণীজন তাদের কর্মে জেলাকে আলোকিত করেছেন। 

এ হলে সত্তর ও আশির দশকে নাট্যাচার্য ড. সেলিম আল দীনের রচিত অনেক মঞ্চনাটক দর্শক মনে সাড়া ফেলেছিল। ভবনটি ভেঙে ফেলায় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কার্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এখন সাংস্কৃতিক কর্মীরা মহড়া দিতে পারছেন না। এতে জেলায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে।

ফেনী থিয়েটারের সাবেক সমন্বয়ক ও জাসাসের ফেনী জেলা সভাপতি কাজী ইকবাল আহম্মদ বলেন, মিলনায়তনটি ভেঙে ফেলায় বর্তমানে ফেনীতে নাট্যচর্চায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। অথচ নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিমও এ মিলনায়তনে নাটক করেছিলেন। আমি দ্রুত মিলনায়তনটি নির্মাণের জোর দাবি জানাচ্ছি।

আলাপন আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র ফেনীর সাধারণ সম্পাদক আবৃত্তি শিল্পী নাজমুল হক শামীম বলেন, মহড়া কক্ষের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে আবৃত্তি চর্চা করতে বেগ পেতে হচ্ছে। অন্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা বাসাভাড়া নিয়ে সাংস্কৃতিক চর্চা করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এতে নতুন শিল্পীরা বিকশিত হতে পারছেন না। যদি জহির রায়হান হলে থাকত তাহলে আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মীদের অনেক সুবিধা হতো।

তিনি আরও বলেন, একসময় জহির রায়হান মিলনায়তনে টিকিট কেটে দর্শক অনুষ্ঠান দেখত। আর এখন শিল্পকলা একাডেমিতে ফ্রি টিকিটেও কেউ যেতে চান না। সাংস্কৃতিক চর্চার পথরুদ্ধ হওয়ায় পাড়ায় পাড়ায় এখন কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। আমি দ্রুত মিলনায়তন নির্মাণ করার জন্য জোর দাবি জানাই। 

জহির রায়হান হল পুনঃপ্রতিষ্ঠা মঞ্চের সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান দারা বলেন, জহির রায়হান হল পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আমরা অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম, মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করেছি। সংশ্লিষ্টদের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এটি দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়িত হয়নি। প্রশাসন থেকে আমাদের বারবার আশ্বাস দিয়েছে কিন্তু আমরা কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পাইনি। আমরা চাই অচিরেই যেন সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রাণের এ মিলনমেলাটি দ্রুত পুনর্নির্মাণ করা হয়।

ফেনী জেলা পরিষদ ও পৌর প্রশাসক এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক গোলাম মোহাম্মদ বাতেন কালবেলাকে বলেন, জহির রায়হান হল পুননির্মাণের জন্য ১১২ শতক জায়গা প্রয়োজন। জায়গার সীমাবদ্ধতার কারণে নকশা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানালে তারা আমাদের যতটুকু জায়গা রয়েছে ততটুকু ধরে নিয়ে প্রস্তাব পাঠানোর জন্য অনুরোধ পাঠায়। আমরা এ বিষয়ে যতটুকু জায়গায় আছে ততটুকু জায়গা ধরে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন এলেই জহির রায়হান হলটি পুনর্নির্মাণ করা হবে।

Read Entire Article