ধর্ষণের মতো অপরাধ কেন হয় ?

2 hours ago 3
প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, দেশে যখন যে অপরাধ নিয়ে খুব কথাবার্তা হচ্ছে, সেই অপরাধের প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে। চারদিক থেকে মহামারির মতো আসছে একই ধরনের অপরাধের সংবাদ। কদিন আগে ছিল ছিনতাই, এখন চলছে ধর্ষণ। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও থেকে একই ধরনের ঘটনার খবর বেরিয়ে আসছে।  এর কারণটা কী? কেন এমন হয়? একটা ধর্ষণ নিয়ে দেশ তোলপাড় হলে অন্য ধর্ষণকামীদের তো চুপ মেরে যাওয়ার কথা। বহু মানুষের প্রতিবাদ দেখে ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তা হচ্ছে না। তারা তো থামছেই না, উল্টো আরও জোরেসোরে নেমে পড়ছে, ঘটাচ্ছে একই ধরনের অপরাধ। কেন এমন হচ্ছে? এর কারণটা হলো- সমাজে যখন যে অপরাধের প্রচার যত বেশি হয়, মানুষের মধ্যে সেই অপরাধ করার প্রবণতাও তত বৃদ্ধি পায়। কেন? এর পেছনে আবার আছে অনেকগুলো কারণ। আসেন দেখি কী সেগুলো : ১. নির্দিষ্ট কোনো অপরাধের সংবাদ বেশি বেশি প্রচারিত হলে মানুষের মধ্যে কেন সেই অপরাধ করার প্রবণতা বাড়ে- এটার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী কন্ট্যাজন ইফেক্ট (Contagion Effect)।  কন্ট্যাজন ইফেক্ট (Contagion Effect) কী? যখন কোনো অপরাধ গণমাধ্যমে বা সামাজিক মাধ্যমে বারবার প্রচারিত হয়, তখন তা অন্যদের জন্য সেই একই অপরাধের এক ধরনের নকশা (template) তৈরি করে। বিশেষত নৃশংস খুন, ধর্ষণ, যে কোনো ধরনের সহিংসতা, আত্মহত্যা বা অস্বাভাবিক অপরাধের ক্ষেত্রে এ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, মিডিয়াতে যখন যে ধরনের অপরাধ নিয়ে বেশি কথাবার্তা হচ্ছে, সেটাই বেড়ে যাচ্ছে সমাজে। মিডিয়ায় প্রচারিত হাই-প্রোফাইল অপরাধের পর অনুরূপ ঘটনা বেড়ে যাওয়ার এই প্রবণতাকে বলে 'Copycat Crime'। Copycat Crime হলো এমন অপরাধ, যা আগে ঘটানো কোনো অপরাধ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সংঘটিত হয়। অপরাধী সাধারণত গণমাধ্যমে প্রচারিত কোনো হাই-প্রোফাইল অপরাধ দেখে সেই অপরাধের ধরন, পদ্ধতি বা বৈশিষ্ট্য অনুকরণ করে অপরাধ সংঘটিত করে। Copycat Crime-এর কিছু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এক নম্বরে আছে অনুকরণ।  অপরাধী মূল অপরাধের ধরন, পদ্ধতি বা উদ্দেশ্য অনুকরণ করতে পারে। একজন শিশু ধর্ষণ করে দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছে, সুতরাং তারও এই কাজ করার খায়েশ জাগে। যদি মিডিয়ায় এমন কোনো সিরিয়াল কিলারের খবর ছড়িয়ে পড়ে যে খুনের সময় নির্দিষ্ট কোনো প্রতীক ব্যবহার করত, তাহলে নতুন অপরাধী একই প্রতীক ব্যবহার করতে পারে। সাধারণত আলোচিত অপরাধ বা (High-Profile Crimes), যে অপরাধগুলো গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়, যেমন ধর্ষণ, সিরিয়াল কিলিং, সন্ত্রাসবাদ বা স্কুল শুটিং- এসবের ক্ষেত্রে Copycat Crime হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। গণমাধ্যমে আত্মহত্যার ঘটনা ব্যাপক প্রচার পেলে অনেকে অনুরূপ পথে যেতে পারে, যাকে ‘Werther Effect’ বলা হয় (গোয়েথের উপন্যাস The Sorrows of Young Werther থেকে উদ্ভূত)। কেন Copycat Crime ঘটে? আত্মপ্রকাশের বাসনা : অপরাধী মনে করে, একইরকম অপরাধ করলে সেও আলোচনায় আসবে। তাকে নিয়েও দেশব্যাপী কথা হবে। এমন কিছু করবে, যাতে সারা দেশ শুধু তাকে নিয়েই কথা বলবে। এই ব্যাপারটা মানুষ এনজয় করে। ভাবে, দিছি একটা লাড়া। এবার যা হওয়ার হোক। এক্ষেত্রে জেল-জরিমানা বা কোনো শাস্তির ভয় তাৎক্ষণিক মনে কাজ করে না। সামাজিক চাপ ও মানসিক অবস্থা : হতাশা, বিচ্ছিন্নতা বা মানসিক অস্থিরতায় থাকা ব্যক্তিরা এমন আচরণে প্রভাবিত হয় সবচেয়ে বেশি। যারা একাকিত্বে ভোগে, তাদের মধ্যেও এই প্রবণতা দেখা যায়। এর থেকে মুক্তির উপায় হলো সোশ্যাল কানেকশনস বৃদ্ধি করা। সামাজিক ও পারিবারিকভাবে মানুষকে যত বেশি কানেক্টেড রাখা যাবে, মানুষ তত অপরাধ থেকে দূরে থাকবে। ২. বেশি প্রচারের ফলে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে দ্বিতীয় কারণটি ব্যাখ্যা করা যায় সোশ্যাল লার্নিং থিওরির (Social Learning Theory) মাধ্যমে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষ অন্যদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে শিখে এবং অনুকরণ করতে আগ্রহী হয়, বিশেষত যখন সেই আচরণকে কার্যকর বা ফলপ্রসূ বলে মনে হয়। যদি অপরাধের মাধ্যমে কেউ খ্যাতি (হোক তা কুখ্যাতি) সহানুভূতি বা ক্ষমতা অর্জন করতে পারে বলে প্রচারিত হয়, তখন কিছু মানুষ সেই আচরণ অনুসরণে আগ্রহী হতে পারে। বিশেষ করে বর্তমানে ভাইরাল হওয়ার যুগে এই প্রবণতা আরো বেড়েছে বহুগুণ। চুরি করে ধরা পড়ে সেই ব্যক্তি এখন সেলিব্রেটি। করোনার সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে ধরা পড়া ডাক্তার এখন এত বড় সেলিব্রেটি যে, তার বই কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে লোকেরা। ৩. অপরাধপ্রবণতার ৩ নম্বর কারণ হলো নরমালাইজেশন (Normalization)। অপরাধের ব্যাপক প্রচার অনেক সময় মানুষের মধ্যে সেই অপরাধকে ‘সাধারণ ঘটনা’ বলে মনে করায়। বারবার একই সংবাদ দেখতে দেখতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যায়। গা সওয়া হয়ে যায়। এতে মানুষের মানসিক বাধাগুলো কমে যায়, ফলে অপরাধ করতে ভয় বা অনুশোচনার মাত্রা কমে যায় ব্যাপকভাবে। নৈতিকভাবে ভেতর থেকে যে বাধাটা আসার কথা, তা না আসার কারণে খুব সহজেই আর দশটা সাধারণ কাজের মতোই সে অপরাধ ঘটিয়ে ফেলে। ৪. অপরাধপ্রবণতার ৪ নম্বর কারণটাও মানুষের মনের সাথে সংশ্লিষ্ট। একে বলে কগনিটিভ বায়াস (Cognitive Bias)। যখন কোনো বহুল প্রচারিত অপরাধের মাত্রা বেশি হয়, মানুষের মনে হয়- এ  অপরাধ তো সমাজে খুবই সাধারণ ঘটনা। অনেকেই করছে। সুতরাং আমি করলে কী এমন দোষ? অন্যদের তো কিছু হচ্ছে না। আমারও হবে না। এই অনুভূতি থেকে মানুষ একই ধরনের অপরাধে লিপ্ত হয় অনেক ক্ষেত্রে। ৫. আবেগ এবং উত্তেজনা (Emotional Arousal)। বহুল প্রচারিত অপরাধ সমাজে বেড়ে যাওয়ার পেছনে এটাও এক বড় কারণ। কিছু মানুষ অতিরিক্ত মিডিয়া কাভারেজ দেখে মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন বা উত্তেজিত হয়ে তাৎক্ষণিক আবেগের বশে অনুরূপ আচরণ করে ফেলতে পারে। অতি প্রচারের ফলে কেন অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে, তা তো জানা হলো। এখন এ থেকে বাঁচার উপায় কী? আশ্চর্য ঘটনা হলো যে, অতিপ্রচারের কারণে একটা নির্দিষ্ট ধরনের অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায় সমাজে, তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্যও দরকার যথাযথ প্রচারণা। Copycat Crime বা এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে মিডিয়া বা প্রচারমাধ্যম। তবে প্রচারের ধরনটা এক্ষেত্রে হতে হবে সম্পূর্ণ আলাদা।  এজন্য সংবাদমাধ্যমকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। অপরাধের গ্লোরিফিকেশন বা নাটকীয় উপস্থাপন না করে বরং সেই অপরাধের নেতিবাচক প্রভাব এবং শিকারদের দুর্ভোগের দিকটি বেশি বেশি তুলে ধরতে হবে। এতে মানুষের মধ্যে সেই আচরণ অনুকরণে নিরুৎসাহিত হওয়ার প্রবণতা বাড়বে। অপরাধীদের পরিচয় বা তাদের মনস্তাত্ত্বিক উদ্দেশ্য নিয়ে অতিরিক্ত মনোযোগ না দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। এমনভাবে অপরাধীদের উপস্থাপন করতে হবে যাতে তারা অহেতুক খ্যাতি অর্জন করতে না পারে। Copycat Crime প্রতিরোধে মূলত একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন, যেখানে গণমাধ্যম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পরিবার ও সমাজ প্রত্যেকেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন Copycat Crime প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। হতাশা, অবসাদ বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা অনেক সময় ব্যক্তিকে অনুরূপ অপরাধে প্ররোচিত করে। এ ধরনের ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের মানসিক সহায়তা দেওয়া হলে তারা অপরাধপ্রবণ আচরণ থেকে দূরে থাকতে পারে। তরুণদের জন্য স্কুল-কলেজে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মশালা আয়োজন করে তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল শেখানো এবং হতাশা মোকাবিলায় সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা অপরিহার্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও এখানে বড় ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যমে অপরাধের প্রচারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি আলোচিত কোনো অপরাধের পর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নজরদারি বাড়ালে অনুরূপ অপরাধ ঘটার আশঙ্কা কমে যায়। কমিউনিটি পুলিশিং, অর্থাৎ স্থানীয় জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে অপরাধ প্রবণতা চিহ্নিত করাও একটি কার্যকর উপায়। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে Copycat Crime প্রতিরোধে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা, সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ গড়ে তুলতে হবে। অপরাধের প্রতি কৌতূহল বা আকর্ষণ তৈরি হওয়ার পরিবর্তে তাদের মনে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পরিবারের ভূমিকাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানদের মানসিক অবস্থা বোঝা, তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা এবং আবেগগত সমস্যা থাকলে সহানুভূতির সঙ্গে তা মোকাবিলা করা অপরিহার্য। পারিবারিক সম্পর্কের উষ্ণতা এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে অনেকেই নেতিবাচক আচরণ থেকে দূরে থাকতে পারে। লেখক : রবিউল করিম মৃদুল, চেয়ারম্যান, অর্থনীতি বিভাগ,  এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
Read Entire Article