গত বছর গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখলাম ১০ বছরের ময়না বাবার সাথে বেড়াতে এসেছে। ওর বাবা আমাদের গ্রামের ছেলে বেলাল। গল্পে গল্পে জানালো বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে ১৪ বছর বয়সে। এই কথা শুনে বিরক্ত হয়ে বললাম, এতটুকু মেয়ের কেউ বিয়ে দেয়? এই মেয়ে সংসারের কী বুঝে? বেলাল স্পষ্ট বললো, এর চেয়ে বয়স বেশি হয়ে গেলে বিয়ে দিতে সমস্যা হয়। তাই গ্রামে এই বয়সেই বিয়ে দেয়। বেলাল বললো, মেয়েদের বেশি পড়াশোনা শিখে কী হবে? সেইতো সংসারই করতে হবে। তাই ভালো পাত্র পেলে সঙ্গে থাকা এই ছোট মেয়েটারও কিছুদিন পর বিয়ে দিয়ে দেবে।
বাংলাদেশের বহু মানুষের এই মনোভাব যে কী ফল বয়ে এনেছে এর প্রমাণ এই রিপোর্ট, “শিশুবিয়ের দিক থেকে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার উপরে। বিশ্বের যে-সব দেশে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে বা শিশুবিয়ে হয়েছে, সেসব দেশের তালিকায় অষ্টম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।” খুব দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্য।
এর চাইতেও বেশি মনস্তাপের কারণ হচ্ছে পত্রিকায় প্রকাশিত এই নিউজটির নিচে অসংখ্য কমেন্টে বাল্যবিয়ের বিষয়টিকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ বলা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে বেলালের মতোই মানুষ বাল্যবিয়েকে ইতিবাচকভাবে দেখছে। আর তাই বাংলাদেশে ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৫১ দশমিক ৪ শতাংশেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর হওয়ার আগে।
বাল্যবিয়ের পক্ষে আরেকটা গ্রুপ আছেন, যারা মনে করেন কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে তারা কন্যার হেফাজত করেছেন, ধর্ম মেনেছেন। স্বামী মেয়েদের প্রকৃত অভিভাবক। গ্রামের ও শহরের অনেক পরিবারেই কন্যাশিশুকে এখনো দেখা হয় বোঝা হিসেবে। ঘাড় থেকে বোঝা নামাতে পারলেই সমস্যা মিটে যায় বলে মনে করেন অনেকে। আমাদের দুর্ভাগ্য বহু বছর ধরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বাল্যবিয়ে নিয়ে কাজ করার পরেও অবস্থা ভালো না হয়ে মন্দের দিকে যাচ্ছে। করোনার সময়ে বাল্যবিয়ের ঘটনা অনেক বেড়েছিল। করোনার পর ছেলেমেয়েদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্য নানাধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও আদতে যে কাজ হয়নি, তা বোঝা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল এর যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত 'গার্ল গোলস: হোয়াট হ্যাজ চেঞ্জড ফর গার্লস? অ্যাডলোসেন্ট গার্লস রাইটস ওভার ৩০ ইয়ার্স' শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কিশোরীদের এখনো প্রতিনিয়ত বৈষম্য, সহিংসতা, শিশুবিয়ে, শিক্ষার সুযোগের ঘাটতি এবং সুযোগ স্বল্পতার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। সমবয়সী ছেলেদের তুলনায় ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী কিশোরী মেয়ে ও তরুণ নারীদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের সুযোগ না পাওয়ার সংখ্যা এখনো দ্বিগুণ।
দেশে বাল্যবয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েগুলো ঋতুকাল সম্পর্কে ঠিকমতো জানে না। জানে না স্বামী সহবাস কী? জানে না পিরিয়ড চলা অবস্থায় তাকে কতটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। দেহের আরও অন্যান্য পরিবর্তন নিয়েও এই ছোট মেয়েগুলোর কোনো ধারণা থাকে না। এতসব অজানা বিষয় ও ভয় নিয়ে তারা যখন স্বামীর সংসারে যায়, তখনো কেউ তাকে কিছু জানায় না। চরম অসহায় বোধ করলেও সেই সংসারে টিকে থাকার চেষ্টা করে তারা।
রিপোর্টটিতে আরো বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরী মেয়েদের ২৮ শতাংশ বিগত ১২ মাসের মধ্যে তাদের সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে। তিন বছর আগে টাঙ্গাইলে ১৪ বছর বয়সী যে মেয়েটিকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার কাছে বিয়েটা ছিল এক আতঙ্কের নাম। শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সময় তার চোখে কোনো স্বপ্ন, আনন্দ ও শিহরন ছিল না, ছিল ভয়। নতুন মানুষ, নতুন জীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ভয়।
সেই কিশোরী মেয়েটির কাছে বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতা আরও বেশি ভয়াবহ ছিল। ২০ বছরের বড় স্বামীর পাশে তাকে দেখাচ্ছিল ভয়ার্ত হরিণীর মতো। অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন সম্পর্কের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাকে শেষ পর্যন্ত মারা যেতে হয়েছিল। মেয়েটি বিয়ে করতে চায়নি। কিন্তু বাবা-মা ধনী ছেলে হাতছাড়া করতে চাননি। শেষ পর্যস্ত মৃত মেয়ে নিয়ে তাদের ঘরে ফিরতে হয়েছে। এরকম আরো অসংখ্য ঘটনা আছে।
শহরে যে কিশোরী মেয়েগুলো কাজ করতে আসে, এদের মধ্যে অনেকেই বিবাহিত এবং সন্তানের মা। গ্রামে বাবা-মা বিয়ে দিয়েছিলেন ১৩-১৪ বছর বয়সে। এরপর মা হয়েছে কিশোরী মেয়েটি। বাচ্চা হওয়ার পর তার প্রতি স্বামীর শারীরিক আকর্ষণ কমতে শুরু করে। একদিন স্বামী উধাও হয়ে যায় অথবা আরেকটা বিয়ে করে সংসার শুরু করে। মেয়ে ফিরে আসে বাবার গৃহে, হয় একা, নয়তো সন্তানসহ। আবার শুরু হয় বাবার বা ভাইয়ের পরিবারে আশ্রিত হয়ে থাকার সংগ্রাম।
বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (বিএসভিএস) -২০২৩ অনুসারে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের সন্তান জন্মদানের হার ৭৩ শতাংশ। আগের বছরের জরিপে এ সংখ্যা ছিল ৭০ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা গেছে, দেশের মোট অন্তঃস্বত্ত্বা নারীর মধ্যে ২৫ শতাংশেরই বয়স ১৫ থেকে ১৯ বছর। কম বয়সে বিয়ের এটাও একটা বড় কারণ। পাত্রপক্ষ মনে করে কম বয়সী মেয়েরা খুব সহজে বাচ্চার মা হতে পারে। অন্যদিকে চিকিৎসকরা মনে করেন এই বয়সে গর্ভধারণ মেয়েদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
বিষয়টি নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, “আমরা প্রায়ই দেখি ১৬ বছরের কম বয়সী মেয়েরা দ্বিতীয়বারের মতো গর্ভধারণ করে আমাদের কাছে আসে। আমরা যখন জিজ্ঞাসা করি কেন তারা গর্ভধারণ করেছে, তখন অনেকে বলে যে বাচ্চা হলে তাদের বিয়ে সুরক্ষিত হয় বা শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক দৃঢ় হয়”। (সূত্র: দি ডেইলি স্টার)।
দেশে বাল্যবয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েগুলো ঋতুকাল সম্পর্কে ঠিকমতো জানে না। জানে না স্বামী সহবাস কী? জানে না পিরিয়ড চলা অবস্থায় তাকে কতটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। দেহের আরও অন্যান্য পরিবর্তন নিয়েও এই ছোট মেয়েগুলোর কোনো ধারণা থাকে না। এতসব অজানা বিষয় ও ভয় নিয়ে তারা যখন স্বামীর সংসারে যায়, তখনো কেউ তাকে কিছু জানায় না। চরম অসহায় বোধ করলেও সেই সংসারে টিকে থাকার চেষ্টা করে তারা। এরা স্কুল, পরিবার, অভিভাবক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে প্রজনন স্বাস্থ্য এবং যৌন জীবন নিয়ে কোনো তথ্য পায় না।
বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বয়সে থাকা শিশুরা এমন একটা সমাজ বা গোষ্ঠীর মধ্যে বাস করে, যারা পুরোনো ধ্যানধারণা বিশ্বাস করে ও চর্চা করে। এরা কোনোভাবেই কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে যৌন জীবন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করে না এবং কেউ করুক এটাও চায় না। অথচ একজন শিশু যখন তার বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছে, তখন তার ভেতরে মনো-দৈহিক, সামাজিক এবং আবেগজনিত অনেক প্রশ্ন দেখা দেয় বা সমস্যা তৈরি হয়। এ সময় নিজের দেহ ও মনের এমন সব পরিবর্তন সে লক্ষ্য করে, কিন্তু সে সম্পর্কে সে জানে না। এবং সেই বয়সেই সে একজন বউ হিসেবে বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করে।
কেন এতো প্রচারণা, আইন-কানুন, সতর্কতা থাকার পরেও কেন সমাজে বউ হিসেবে শিশু-কিশোরীর চাহিদা বাড়ছেই? কারণ দেশের শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত মানুষের একটা বড় অংশই তাদের শারীরিক ও অন্য চাহিদা মেটানোর জন্য কম বয়সী মেয়ে বিয়ে করতে চায়। তারা মনে করে ১৫ থেকে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েরাই প্রকৃত ‘কুমারী’। এই বয়সীদের বিয়ে করলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। পাত্রপক্ষ এই বয়সের মেয়ের খোঁজ করে বলেই, পাত্রীর অভিভাবকরা এই বয়সেই বিয়ে দেয়াটা সহজ মনে করেন।
আইনের ফাঁক দিয়ে অসংখ্য শিশু-কিশোরীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অভিভাবক, ঘটক, পাত্রপক্ষের যোগসাজশে। কম বয়সী মেয়েগুলো যখন বিয়ের পর বাবার বাড়িতে আসে, তখন বোঝা যায় তারা শ্বশুরবাড়িতে কতটা নির্যাতন, নিপীড়ন ও দারিদ্র্যের মধ্যে থাকে। সংসারের প্রায় সব কাজ ঘরের বউকে দিয়ে করানো হয় এবং সবচেয়ে কম খাবার খেতে দেওয়া হয়। এরপর যখন ক্লান্ত দেহ নিয়ে এরা স্বামীর যৌন চাহিদা মেটাতে পারে না, তখন স্বামী মুখ ফিরিয়ে নেয়, নির্যাতনও করে। কারো স্বামী কাজ করতে গ্রামের বাইরে যায়, কারো স্বামীর সাথে তালাক হয়ে গেছে, কারো স্বামী আছে কিন্তু খোঁজখবর রাখে না। সেই শিশু মা এবং সন্তান দুজনেরই লাবণ্যহীন ভাঙা শরীর। চোখে-মুখে দারিদ্র্য ও অপুষ্টির ছাপ স্পষ্ট। এদের কেউ কেউ রক্তশূন্যতায় ভুগছে। অথচ এই কথা মেয়েগুলো মা-বাবাকে বলতে চায় না। কারণ বাবা-মা মনে দুঃখ পাবেন, আর বললেও মা-বাবা বিশ্বাস করেন না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত 'বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২৩ (বিএসভিএস-২০২৩)' শীর্ষক জরিপে দেখা গেছে, গত তিন বছরে দেশে বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেড়েছে। গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেশি। সেখানে ৪৪ দশমিক চার শতাংশ নারীর বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সের আগে। বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েদের মধ্যে যারা গর্ভবতী হচ্ছে, তাদের শতকরা ২৫ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ১৯। এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সাম্প্রতিক এক সরকারি গবেষণায়। অপরিচিত পরিবেশ, বয়স্ক স্বামী, বয়ঃসন্ধিকালের দৈহিক সম্পর্ক, বৈবাহিক জীবন ও দাম্পত্য সম্পর্ক এবং অপরিণত বয়সে সন্তানধারণ শিশু-কিশোরীদের খুবই শঙ্কার মধ্যে ফেলে দেয়। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, প্রতিরোধ সত্তে¡ও আমরা দেশে বাল্যবিয়ে রোধ করতে পারছি না। (তথ্যসূত্র ইউনিসেফ)।
কম বয়সে বিয়ে না হলে মেয়ে নষ্ট হয়ে যাবে অনিরাপত্তা বোধটাও সমাজ চাপিয়ে দিয়েছে। পাড়া-প্রতিবেশীদের হুঁশিয়ারি ও ভয়-ভীতি, লোকলজ্জা ও ভয়ে কন্যাশিশুর অভিভাবকেরা বাল্যবিয়ের মতো ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আরেকটা হচ্ছে ’ভালো ছেলে’ হাতছাড়া হলে আর পাওয়া যাবে না। এই ’ভালো ছেলে’ এর মানদণ্ড একটাই, তা হচ্ছে ’টাকা’। এই বিয়ে দেওয়ার কাজে সবচেয়ে সক্রিয় থাকেন ঘটকরা। ৪১ শতাংশেরও বেশি মেয়ের বিয়ে হয় ঘটকদের ফন্দি ফিকিরে পড়ে।
নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি যতো বাড়ছে, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ততো বেশি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। অভিভাবকদের মনে ভয় বাড়ছে। মেয়ের ‘সম্ভ্রম’ চলে যায় কি না কিংবা মেয়ের কারণে পারিবারিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় কি না, যুক্ত হয়েছে সেই আশঙ্কা। মেয়ে ধর্ষণ বা অপহরণের শিকার হতে পারে, না বুঝে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে পারে, পরবর্তীতে বিচার নাও পেতে পারেন ইত্যাদি শঙ্কা পরিবারে কাজ করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপরাধ তাদের ভয় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।
এইচআর/জেআইএম