নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন: ‘আমাদের নিয়ত সহিহ। আমরা জাতিকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে চাই। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে যা করা দরকার, তাই করব।’
রবিবার (২৪ নভেম্বর) সিইসি হিসেবে শপথ গ্রহণের পরে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনগণের সহযোগিতা লাগবে, রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা লাগবে। সবার সহযোগিতা পেলে জাতিকে একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দেয়া সম্ভব হবে। সিইসির সহিহ নিয়তের বিষয়টা ধরেই এগোনো যাক।
প্রশ্ন হলো, সিইসি তথা তার পুরো কমিশন চাইলেই কি জাতিকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দিতে পারবে? সিইসি সবার সহযোগিতার কথা বলেছেন। এই সবাই বলতে কাদেরকে বোঝানো হচ্ছে এবং তাদের কাছ থেকে নির্বাচন কমিশন কী ধরনের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে?
অতীতে যেসব নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, বিশেষ করে বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থাটিই যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, তার জন্য নির্বাচন কমিশন কি তার দায় এড়াতে পারে? তাহলে কি ওই তিনটি কমিশনের নিয়ত সহিহ ছিল না নাকি তারা সকলের সহযোগিতা পায়নি? অংশীজনরা যদি নির্বাচন কমিশনকে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহযোগিতা না করে, তাহলে সেক্ষেত্রে ইসির করণীয় কী? ‘সহযোগিতা পাইনি’ অজুহাতে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার দায় কি তারা এড়াতে পারে?
নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশন গত শনিবার (২৩ নভেম্বর) সকালে বৈঠক করেছে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানলেগুলোর সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে। সেখানে একাধিক সাংবাদিক বলেছেন, বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা সিইসি ও কমিশনারদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। তাদের যুক্তি, ওই কমিশনগুলো যেহেতু সরকার ও সরকারি দলের চাপ এবং অংশীজনের সহযোগিতার অভাবে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে না পারার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেনি, অতএব খারাপ নির্বাচনের দায় তাদেরই। প্রশ্ন হলো, তারা কি রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে পদ ছেড়ে যাননি, নাকি নির্বাচনি ব্যবস্থাটি ধ্বংস হচ্ছে জেনেও তারা এটা মেনে নিয়েছিলেন এই যুক্তিতে যে, তাদের কিছু করার নেই?
সিইসি কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশনের অন্যতম কমিশনার মাহবুব তালুকদারই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি যিনি পদে থাকা অবস্থায় নির্বাচনি অনিয়ম নিয়ে বেশ সোচ্চার ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে মিটিংয়ে তিনি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ও দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো তিনিও পদত্যাগ করেননি। বিভিন্ন সময়ে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি পদত্যাগের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেননি। যদিও গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন পদত্যাগ করেছে। মূলত তাদের এই পদত্যাগের দাবি উঠেছিল সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দানকারী শিক্ষার্থীদের ভেতর থেকেই। ফলে তাদের পক্ষে আর ওই পদে বসে থাকার সুযোগ ছিল না।
ভালো নির্বাচন মানে কী?
এবার আসা যাক ভালো তথা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন বলতে কী বুঝায় এবং শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের নিয়ত সহিহ থাকলেই সেরকম ভালো ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব কি না? নির্বাচনে কয়েকটি ঘটনা ঘটলে সেটিকে ‘ভালো’ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন বলা যায়। যেমন:
১. তফসিল ঘোষণার পর আগ্রহী সব প্রার্থী নির্বিঘ্নে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পেরেছেন।
২. মনোনয়ন যাচাই-বাছাইয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা রাজনৈতিক কারণ বা অন্য কোনোভাবে প্রভাবিত হননি।
৩. প্রতীক বরাদ্দের পরে প্রার্থীরা আচরণবিধি মেনে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন এবং সেখানে নির্বাচন কমিশন সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করেছে।
৪. কোনো প্রার্থীকে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার বা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে সরকার, সরকারি দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা কোনো এজেন্সির তরফে চাপ প্রয়োগ করা হয়নি।
৫. নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ভোটের একটি সুন্দর ও উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় ছিল।
৬. ভোটের দিন ভোটাররা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়েছেন এবং পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্ভয়ে ফিরতে পেরেছেন।
৭. জাল ভোট, কেন্দ্র দখল বা সহিংসতা হয়নি।
৮. ভোট গণনায় কোনো ধরনের কারচুপি করা হয়নি।
৯. কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে জয়ী করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা উৎসাহ দেখাননি না বা তাদের ওপর কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় চাপ ছিল না।
১০. ভোটের ফলাফল ঘোষণার পরে প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থী সেটি মেনে নিয়েছেন।
সুষ্ঠু মানেই বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন?
পুরো নির্বাচনি প্রক্রিয়াটি শান্তিপূর্ণ হওয়ার পরও সেই ভোট গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। যেমন, একটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের ফল ঘোষণা পর্যন্ত কোনো হানাহানি হলো না, কোনো প্রার্থীর প্রচারে বাধা দেওয়া হলো না, কাউকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে চাপ দেওয়া হলো না; কিন্তু দেখা গেলো মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি বা ভোটার উপস্থিতি খুবই কম।
যেহেতু সংবিধানে ন্যূনতম ভোটের বিধান নেই, অর্থাৎ নির্বাচনে কত শতাংশ ভোট পেতে হবে এবং প্রাপ্ত ভোটের কত শতাংশ না পেলে জয়ী বলা যাবে না—এমন কোনো বিধান যেহেতু সংবিধানে বা নির্বাচনি আইনে (আরপিও) নেই, ফলে অনেক সময় দেখা গেছে ১০ শতাংশ ভোট পেয়েও অনেকে এমপি বা মেয়র নির্বাচিত হয়ে গেছেন। এটিকে সুষ্ঠু ভোট বলা হলেও কোনো অর্থেই ভালো নির্বাচন বলা যায় না। আবার বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেলে সেখানে কোনো ভোটই হয় না। ভোট না হলে সেখানো কোনো সংঘাত হয় না। তাতে ওই ভোটটি শান্তিপূর্ণ বা সংঘাতমুক্ত হলো বটে, কিন্তু এটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নয়।
অনেক সময় এমনও হতে পারে যে, ভোট শান্তিপূর্ণ হলো, প্রচুর মানুষ ভোট দিলো, কিন্তু ফল পাল্টে দেওয়া হলো। সেটিও সুষ্ঠু বা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নয়।
সুতরাং নির্বাচন কমিশনের কাজ শুধু নির্বাচন আয়োজন করা নয়। বরং নির্বাচনটি বিশ্বাসযোগ্য হলো কি না, সেটি নিশ্চিত করাও জরুরি। আর সেটি নিশ্চিত করতে চাইলে সকল অংশীজনের সহযোগিতা প্রয়োজন। যেকোনো নির্বাচনে কয়েকটি স্টেকহোল্ডার বা অংশীজন থাকে। যেমন:
১. নির্বাচন কমিশন।
২. সরকার তথা নির্বাহী বিভাগ।
৩. সরকারি/ক্ষমতাসীন দল।
৪. নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল দল।
৫. নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল প্রার্থী।
৬. মাঠ প্রশাসন।
৭. সশস্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
৮. গণমাধ্যম।
প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নেই। ভোট পরিচালনায় যে বিপুল সংখ্যক জনবল দরকার, সে পরিমাণ লোক তার নেই। ফলে তাকে পুরো নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্ভর করতে হয় নির্বাহী বিভাগ তথা সরকারের ওপর। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ বলছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন ভোট পরিচালনার জন্য সরকারের কাছে যে সহায়তা চাইবে, সরকার সেটি দিতে বাধ্য। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকেন তারা সরাসরি নির্বাচন কমিশনের কর্মী নন। বরং তারা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োজিত এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তা ব্যক্তিরা যা বলবেন, যে নির্দেশনা দেবেন, তার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং তারা কতটা নিরপেক্ষভাবে ভয়-ভীতি ও লোভের ঊর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন, তারওপর নির্ভর নির্বাচনটি কেমন হবে। অর্থাৎ মাঠ প্রশাসন যদি ইসিকে সহায়তা না করে; তারা যদি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর মতো আচরণ করে; মাঠ প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ না থাকে বা থাকতে না পারে— তাহলে খুব ভালো নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয়।
নির্বাচন প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে, তার ওপরে অনেকখানি নির্ভর করে সেই নির্বাচনটি কেমন হবে। অর্থাৎ সব প্রার্থীর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ রয়েছে কি না, সেটি মূলত ধরা পড়ে সাংবাদিকের চোখে। গণমাধ্যম যদি সেই বাস্তবতাটি নির্ভয়ে প্রচার ও প্রকাশ করতে পারে, তাহলে নির্বাচন কমিশন তো বটেই, সরকারও চাপের মধ্যে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার চেয়ে এখন সেলফ সেন্সরশিপের বিষয়টি এতটাই মুখ্য হয়ে উঠছে যে, তারা নিজেরাই সব তথ্য প্রচার ও প্রকাশ করে না অথবা ঘটনার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করে না। ফলে গণমাধ্যমের এই সেলফ সেন্সরশিপও ভালো ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে।
ধরা যাক, সিইসি ও কমিশনার হিসেবে দেশের সবচেয়ে মেধাবী, যোগ্য, সৎ ও সাহসী মানুষেরাই নিয়োগ পেলেন। কিন্তু একটি নির্বাচন শুধু নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না। পুরো সিস্টেম যদি ভালো নির্বাচনের সহায়ক না হয়, তাহলে একজন সিইসি এবং চারজন কমিশনারের পক্ষে কিছুই করার নেই। তাদের নিয়ত যদি সহিহ হোক না কেন, পুরো সিস্টেম যদি তাদেরকে সহযোগিতা না করে তাহলে তাদের পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব নয়।
যদি সরকার তথা নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে পুরোপুরি সহযোগিতা না দেয়; যদি রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা আচরণবিধি মেনে দায়িত্বশীল আচরণ না করেন, তাহলে শুধুমাত্র পুলিশিং বা বিচার করে নির্বাচনের পরিবেশ ঠিক রাখা সম্ভব নয়।
পরিশেষে, সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এবার যারা নিয়োগ পেলেন, তারা যেহেতু একটি নির্দলীয় সরকারের আমলে নিয়োগ পেয়েছেন, ফলে এটি ধারণা করা যায় যে, তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্তত দলীয় বিবেচনা ছিল না। ফলে এটি তাদের প্রথম শক্তি। দ্বিতীয় শক্তি হচ্ছে সিইসির ভাষায় তাদের নিয়ত ‘সহিহ’। যদি তারা সত্যিই এটা বিশ্বাস করেন যে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করার বাইরে তাদের আর কোনো এজেন্ডা নেই, তাহলে তাদের পক্ষে হয়তো একটি উদাহরণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব হবে। তবে শর্ত হলো সকল স্টেকহোল্ডার বা অংশীজনের সহযোগিতা ছাড়া শুধুমাত্র সিইসির সহিহ নিয়তের ওপর ভালো নির্বাচন নির্ভর করে না।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক
এইচআর/জেআইএম